বিএনপি-জামায়াতের কৌশলী অবস্থান

দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগকে দুরভিসন্ধিমূলক মনে করছে বিএনপি ও তার অন্যতম মিত্র জামায়াতে ইসলামী। তবে এখনই বিষয়টিকে গ্রহণ বা বর্জনের অবস্থান স্পষ্ট করেনি দল দুটি। যদিও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই জোটের বাইরে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, এতে করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও সংকুচিত ও দুর্বল হবে। দলতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে। সোমবার নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য পাঁচটি আইন সংশোধনের প্রস্তাবে সম্মতি দেয় মন্ত্রিসভা। শাসকদল আওয়ামী লীগের শরিকরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার প্রস্তাব অনুমোদন পায়। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) সংশোধনী আইন জারি করা হবে। কারণ পৌরসভা নির্বাচন আসন্ন এবং এ মুহূর্তে সংসদ অধিবেশন চলছে না। স্থানীয় পর্যায়ের এ নির্বাচনে দলীয় ভূমিকা থাকায় প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক শেষে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জানিয়েছেন।
দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ সম্পর্কে অনেকটাই কৌশলী মন্তব্য করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিশদলীয় জোটের শরিকরা। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে গ্রহণ বা বর্জনের বিয়ষটি স্পষ্ট না করে বিএনপি আইন সংশোধনের উদ্যোগে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্থানীয় সরকারের বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা দাবি করেছিলাম যেন সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত যাচাই করা হয়। কিন্তু আমাদের দাবিকে পাশ কাটিয়ে একগুঁয়েমি মনোভাব প্রদর্শন করে তড়িঘড়ি করে এ সংক্রান্ত পাঁচটি আইনের সংশোধন প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। আমরা এতে বিস্মিত হয়েছি। তিনি বলেন, এটা সরকারের অসৎ পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। তিনি বলেন, দলবাজি ষোলকলায় পরিপূর্ণ করে অঘোষিত বাকশাল কায়েমের নীল নকশা থেকেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জামায়াতের এই নেতা অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে সবার আগে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানান। বিএনপির মতো জামায়াতও সরকারের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি।
এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার দাবি আমাদের পার্টির দীর্ঘদিনের। কিন্তু আমরা আরও জোর দিয়ে আগাগোড়া দাবি করে এসেছি যে-টাকার খেলা, পেশিশক্তির ব্যবহার, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ইত্যাদি থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করাটা সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য বলে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু সেই অগ্রাধিকারমূলক জরুরি কর্তব্য পালন না করে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন করা জনগণের ক্ষমতায়নের বদলে ক্ষমতাসীনদের গদি আঁকড়ে থাকার সুযোগই সৃষ্টি করবে। এর ফলে দেশে বিদ্যমান দুটি বুর্জোয়া দলের একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রাখার সুযোগ করে দেবে। দলতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন তৃণমূলে দলীয়করণ ও দলবাজিকে আরও পাকাপোক্ত করবে। বহু দশক ধরে চলে আসা নির্দলীয় স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে দলীয় চেহারা দেয়ার মধ্য দিয়ে সরকার যে সবকিছুতে দলীয় আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে চায় তা স্পষ্ট। রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামতের তোয়াক্কা না করে সরকার যেভাবে এই ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল তা স্বেচ্ছাচারী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। কোনো সৎ উদ্দেশ্য থেকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি তাও স্পষ্ট। তিনি বলেন, এতে করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও সংকুচিত ও দুর্বল হবে।
তবে এ মতের বিরোধিতা করে শাসকদল আওয়ামী লীগের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরোক্ষভাবে দলীয়ভাবেই হয়ে আসছে।
সরাসরি দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভালোমন্দের দায়ভার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেই নিতে হবে। দল থেকে মনোনীত জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম করলে জনগণের কাছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকেই জবাবদিহি করতে হবে।