বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সংসদ ছাড়বে ॥ পদত্যাগ করতে পারে

13/10/2013 6:39 pmViews: 11

1363514509BNP-flag-big-18-dalশরীফুল ইসলাম ॥ নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ২৫ অক্টোবর থেকে লাগাতার কঠোর আন্দোলন কর্মসূচীর প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। আন্দোলন জোরদার করতে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে বিএনপি ও সমমনা দলের সংসদ সদস্যরা একযোগে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিকেও এ আন্দোলনে শরিক করতে চাচ্ছে বিএনপির একটি অংশ। তবে এরশাদকে সঙ্গে নেয়ার ব্যাপারে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ১৮ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতের আপত্তি রয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার আস্থায় আসার জন্য ইদানীং এরশাদ বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা কথা বলছেন। এভাবে আবোলতাবোল কথা বলার জন্য দেশবাসীর আস্থা হারাচ্ছেন এরশাদ।
২৫ অক্টোবর রাজধানীতে জনসভা করার মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছে বিএনপি। এই জনসভা থেকে লাগাতার হরতালসহ রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া ২৪ অক্টোবরের পর জাতীয় সংসদের অধিবেশন চললে সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর সংসদ সদস্যরা একযোগে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশন ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত চালানোর সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু আমাদের আন্দোলন ঠেকাতে ২৪ অক্টোবরের পরও সংসদ চালানোর ষড়যন্ত্র চলছে। ২৪ অক্টোবরের পরও সংসদ চললে বিএনপি পদত্যাগ করবে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে দল পরে সিদ্ধান্ত নেবে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ২৫ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া আন্দোলনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি শরিক হলে এ আন্দোলন দ্রুত বেগবান হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারও বড় রকমের হোঁচট খেয়ে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়বে।
বিএনপির এবারের আন্দোলন কর্মসূচীতে ১৮ দলীয় জোটের প্রতিটি শরিক দলের পাশাপাশি আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগকে বড় রকমের চাপে ফেলতে বর্তমানে মহাজোট সরকারের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টিকেও আন্দোলনে শরিক করতে চাচ্ছে বিএনপির একটি অংশ। তবে এই আন্দোলন অথবা নির্বাচনী জোটে এরশাদকে নেয়ার ব্যাপারে জামায়াতের ঘোর আপত্তি রয়েছে। জামায়াত মনে করছে, এরশাদের জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে মিশে গেলে জোটে জামায়াতের কদর কমে যাবে। তারপরও বিএনপির একটি অংশের চাপে খালেদা জিয়া নমনীয় হলে শেষ পর্যন্ত মহাজোট ছেড়ে এরশাদ বিএনপির সঙ্গে এসে জোট বাঁধতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
জানা যায়, ২৫ অক্টোবর থেকে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে রাজধানীতে বড় ধরনের শোডাউন করা না গেলে দেশের অন্যান্য জেলায় শোডাউন করার চেষ্টা করা হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া, খুলনা, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলার সঙ্গে এরশাদের সমর্থন নিয়ে রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে আন্দোলন চাঙ্গা করা সম্ভব হবে।
জানা যায়, কাজী জাফর ও রুহুল আমীন হাওলাদারসহ জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সিনিয়র নেতাও বিএনপির একাংশের নেতাদের প্রস্তাবমতে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে ২৫ অক্টোবর থেকে আন্দোলনে যাওয়ার পক্ষে। আর তাঁদের চাপাচাপিতে এরশাদও মহাজোট ত্যাগ করে বিএনপির সঙ্গে যেতে চান। আর এ কারণেই খালেদা জিয়াকে খুশি করতে ইদানীং তিনি বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ কিছু সিনিয়র নেতা এরশাদকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই হঠাৎ করে কখনও কখনও সরকারের পক্ষেও কথা বলেন।
অবশ্য ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করেন। তবে ইদানীং তিনি বেসামাল কথা বলছেন। আজ এক কথা বলেন তো কাল তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেন। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গিয়ে তাঁর অবস্থান ঠিক না থাকায় দেশের মানুষের তাঁর ওপর আস্থা কমে গেছে। সম্প্রতি এক জরিপে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এরশাদের উল্টাপাল্টা কথার কারণেই তাঁর দলের জনপ্রিয়তা কমেছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।
গত ১১ অক্টোবর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির নতুন অফিস উদ্বোধনকালে এরশাদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহা স্বৈরশাসক। এই দুই দলের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়। এখন আমাদের লক্ষ্য একটাই, কী ভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না গেলে দেশে নির্বাচন হবেই না। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন আতঙ্কে দিশেহারা।’ ৭ অক্টোবর বনানীর দলীয় কার্যালয়ে এরশাদ বলেন, কাউকে ক্ষমতায় বসাতে আমরা নির্বাচনী ফাঁদে পা দেব না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানে এবং সব দল যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে যাবে না। আবার ৬ অক্টোবর রংপুরে এক সমাবেশে তিনি বলেন, রংপুরের ২২ আসনে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ৪ অক্টোবর হবিগঞ্জে এক দলীয় সমাবেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে না বলে সংশয় প্রকাশ করেন। ২ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে এরশাদ বলেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী না দিয়ে ভোট হতে হবে দলভিত্তিক। অর্থাৎ দেশের মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে তার ভিত্তিতে সংসদীয় আসন ভাগ হবে। এর আগে ২৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় যুবসংহতির মতবিনিময় সভায় এরশাদ বলেন, আওয়ামী লীগ একটি ধিকৃত দল, আগামী নির্বাচনে এ দল ৬০ আসনের বেশি পাবে না। এর এক দিন পর ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর প্রেস সচিবের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে আগের দিনের কথা অস্বীকার করেন। এমনিভাবে এরশাদ কখনও বলছেন মহাজোটে আছি এবং থাকব। কখনও বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হবে এমন জোটে আমরা যাব। কখনও বলছেন, আমরা কারও সঙ্গে জোট করব না, মহাজোট ছেড়ে দেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কখনও বা বলছেন আমরা এককভাবেই নির্বাচন করব। আবার কখনও বলছেন, আমরা কারও সঙ্গে জোট করতে যাব না, আমাদের সঙ্গেই অনেকে আসবে। এ ছাড়া শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর প্রথমে তিনি তাদের স্বাগত জানালেও পরে ব্লগারদের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের পক্ষ নেন।
সম্প্রতি রাজশাহীর জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেন, মহাজোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টিও এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। পরক্ষণেই খালেদা জিয়া বলেন, এরশাদকে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন।
এরশাদ আবোলতাবোল কথা বললেও উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্তত ৪০টি আসনে ভোট ব্যাংকের হিসাবে জাতীয় পার্টির অবস্থান ভাল থাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই তাদের নির্বাচনী জোটে এরশাদকে রাখতে চাচ্ছে। স্থগিত হওয়া ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও এরশাদকে নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ রশি টানাটানি করেছে। এবারও নির্বাচন সামনে রেখে এরশাদকে নিয়ে রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। আর এরশাদও পরম তৃপ্তিভরে এটা উপভোগ করছেন এবং একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি বাতিল হয়ে গেলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এ আন্দোলনে সব রাজনৈতিক দলকে শরিক হতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আহ্বান জানান। ১৮ দলীয় জোটের বাইরে বিকল্পধারা এ আন্দোলনে শরিক হলেও এর বাইরে আর কোন দল আসেনি। তাই বিএনপি চাচ্ছে ২৫ অক্টোবর থেকে যে আন্দোলন শুরু হচ্ছে তাতে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত করতে। এরই অংশ হিসেবে বিএনপির একটি অংশ এরশাদের জাতীয় পার্টিকে আন্দোলন ও নির্বাচনী জোটে শরিক করতে চাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

Leave a Reply