বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ চুরির দায় এড়াতে পারে না ফেডারেল রিজার্ভ
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে গেছে গত ৪ ফেব্রুয়ারি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাক করে সাইবার অপরাধীরা ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধীরা ফিলিপাইনের আরসিবিসি নামের একটি কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার শাখাকে ব্যবহার করেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), ফিলিপাইনের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) পৃথকভাবে তদন্ত করছে। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে গচ্ছিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনও (আরসিবিসি) সমানভাবে দায়ী। তিনি বলেন, ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরসিবিসিকে চাপ দিলে চুরি হওয়া অর্থ খুব সহজেই ফেরত পাবে বাংলাদেশ। তবে যেহেতু টাকার একটা বিরাট অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে তাই এটাকে ফিরিয়ে আনা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোলে হয়তো এ টাকা ফেরত পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিজস্ব প্রতিবেদক মানিক মুনতাসির।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে গচ্ছিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারমেশন না পেয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনও (আরসিবিসি) সমানভাবে দায়ী। ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য শুরু থেকেই অনেক তত্পর। তারা যদি আরসিবিসিকে চাপ দিয়ে বলতে পারে তোমরা ভুল করেছ, ক্ষতিপূরণ তোমাদেরই দিতে হবে। তাহলে চুরি হওয়া অর্থ খুব সহজেই ফেরত পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু যেহেতু টাকার একটা বিরাট অংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে তাই এটাকে ফিরিয়ে আনা বেশ কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোলে হয়তো এ টাকা ফেরত পেতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তবে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংককে এককভাবে দায়ী করা যাবে না। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা থাকতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, পুরো প্রতিষ্ঠানই দুর্বল। তবে হ্যাঁ, এসব ব্যাপারে তথ্যপ্রযুক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে আমাদের বিশ্ব সক্ষমতার কাতারে উঠে আসতে হবে। যেন পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ২০০৫ সালের ১ মে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রিজার্ভ চুরির ঘটনা দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে আপনি মনে করেন।
সালেহ উদ্দিন : দেখুন এ ধরনের ঘটনা তো আর সব সময় ঘটে না। এটাকে একটা দুর্ঘটনাও বলা যেতে পারে। এ ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব খুব একটা পড়বে না বা পড়ছেও না। তবে ব্যাংক খাতে মানুষের আস্থায় সামান্য চির ধরাতে পারে এ ঘটনা। এতে কিছুটা আস্থার সংকটও দেখা দিতে পারে। কিছুটা সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইমেজ কিছুটা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখানে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়টা কম, তা কিন্তু আমাদের জন্য ভালো।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় কতটা বলে আপনি মনে করেন।
সালেহ উদ্দিন : প্রথম কথা হচ্ছে এটা তো তদন্তাধীন বিষয়। আর যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে, তাই তদন্তসাপেক্ষে বলা যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় কতটা। এখানে আসলে কার দোষ সেটা হয়তো তদন্তের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য পুরো বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করা যাবে না। এখানে একটা সিস্টেমের অপব্যবহার করা হয়েছে। বা কোনো একটা সিস্টেমকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কোনো একটি বিভাগের দুর্বলতা থাকতেই পারে। সেই বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কেউ কেউ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করছেন। এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। কেননা এটা একটা সিস্টেমের সমস্যার কারণে হয়েছে। যাকে প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও বলা যেতে পারে। আর যে কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন দুর্বলতা থাকতেই পারে। ফলে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করাটা সমীচীন হবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ফেডারেল রিজার্ভ কি এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে বলে আপনি মনে করেন।
সালেহ উদ্দিন : দেখুন এ ঘটনার জন্য মূলত ফেডারেল রিজার্ভ কর্তৃপক্ষই দায়ী। তাদের দোষটাই বেশি। একই ঘটনার ক্ষেত্রে অন্য পেমেন্টগুলো তারা দিল না। কিন্তু পাঁচটি পেমেন্ট তারা দিয়ে দিল কোনো প্রকার কনফারমেশন ছাড়াই। অথচ এটা তো তাদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা। এ জন্য দায়টা তাদেরই বেশি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী।
সালেহ উদ্দিন : এখানে একটা বিষয় হলো কিছু অর্থ ইতিমধ্যে আমরা ফেরত পেয়েছি। আর সেগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলের ভিতরেই ছিল এবং তা তারা খরচও করতে পারেনি। এর একটা অংশ শ্রীলঙ্কা থেকেই ফেরত এসেছে। তাও অব্যয়িত ছিল। এখন যে টাকা অন্য দেশের ক্যাসিনোতে খরচ হয়ে গেছে বা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চলে গেছে তা ফেরত পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গেলে টাকাটা ফেরত পেতে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। তবে এখানে একটা আশার দিক হচ্ছে, ঘটনার সুরাহা করতে ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ তত্পরতার সঙ্গে কাজ করছে। তারা যদি আরসিবিসিকে বাধ্য করে তাহলে বাংলাদেশ খুব সহজেই টাকাটা ফেরত পেয়ে যাবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সুইফট কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সিস্টেমে কোনো ত্রুটি ছিল না। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন।
সালেহ উদ্দিন : সুইফট কর্তৃপক্ষ সরাসরি এটা বলতে পারে না। কোথাও না কোথাও তো একটা সিস্টেমের সমস্যা ছিল। যার কারণে এ ঘটনাটা ঘটেছে। এতে সুইফট কর্তৃপক্ষেরও কারিগরি ত্রুটি থাকতেই পারে। তা তাদের স্বীকার করা উচিত। এমনকি তাদের সার্ভারেও সমস্যা থাকতে পারে। যার কারণে অপরাধীরা সে সুযোগ ব্যবহার করেছে। নিশ্চয়ই অপরাধীরা কারও না কারও সার্ভারে প্রবেশ করেছিল, তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ বুঝতে পারেনি। ফলে সমস্যাটা কার ছিল তাও তো পরিষ্কার বলা যাবে তদন্তের মাধ্যমেই। এখানে অবশ্য অনেক প্রশ্নও রয়েছে। দুই দেশে একযোগে সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। বাংলাদেশে সরকারি ছুটির দিন ছিল। এসব প্রশ্নের উত্তর আশা করি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ঘটনার পর থেকে ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্পরতার বিষয়ে কিছু বলুন।
সালেহ উদ্দিন : এখানে আশার দিক হচ্ছে, ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বেশি তত্পরতার সঙ্গে কাজ করছে। অবশ্য তাদের দায়টাও বেশি। ইতিমধ্যে তারা অনেক পদক্ষেপও নিয়েছে। ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। সে দেশের সংসদে বিষয়টি নিয়ে শুনানি হয়েছে, হচ্ছে। এসব কিন্তু ইতিবাচক দিক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন।
সালেহ উদ্দিন : সবার আগে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দক্ষ লোক গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। শক্তিশালী সার্ভার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প সার্ভারের ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সাম্প্রতিক রিজার্ভ চুরির ঘটনার পাশাপাশি এর আগে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসবের মূল কারণ কী বলে আপনার মনে হয়।
সালেহ উদ্দিন : আর্থিক জালিয়াতি ঘটে মূলত সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির পাশাপাশি অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজেদের সক্ষমতা ও তদারকিরও অভাব রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যাংক সংশ্লিষ্ট লোকদের অর্থাৎ ব্যাংকিং সিস্টেমে যারা কাজ করছেন তাদের নীতি নৈতিকতার বিষয়। ব্যাংকারদের সততা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা ছাড়া স্বচ্ছ ব্যাংক খাত গড়ে তোলা দুরূহ।
বিডি-প্রতিদিন/১১ এপ্রিল, ২০১৬/মাহবুব