বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনে হতাশ পশ্চিমা বিশ্ব
গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিরোধীদলবিহীন একতরফা সংসদীয় নির্বাচনে হতাশা ব্যক্ত করেছে আমেরিকা, বৃটেন ও কানাডাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ।
বিতর্কিত এই ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং বাকিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আসনেই নামে মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেন, অধিকাংশ আসনেই নামে মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ফলে এই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশী জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন নয়। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে এই বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
বিবৃতিতে মেরি হার্ফ বলেন, “নতুন সরকারের রূপ কী হবে সেটা ভবিষ্যতেই জানা যাবে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার অঙ্গীকার অটুট থাকবে। এই সুবাদে আমরা বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলকে অবিলম্বে সংলাপে বসার জন্য উৎসাহিত করছি যার মাধ্যমে তারা যতো শিগগির সম্ভব একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খুঁজে বের করবে- যেটি হবে অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য এবং যা বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাবে।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে বিরাজমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় সকল পক্ষ থেকে যে সহিংস কার্যকলাপ ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র তীব্র ভাষায় তার নিন্দা জানাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়; এধরনের সহিংস কার্যকলাপ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আমরা সকলের প্রতি আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা এবং যারা পরবর্তীতে নেতৃত্ব দেয়ার আকাঙ্খা পোষণ করেন আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে তাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তাদের তা করতে হবে। পাশাপাশি সহিংসতার প্রতি সমর্থন প্রদান, বিশেষ করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতায় প্ররোচিত করা থেকে, উসকানিমূলক বক্তব্য ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে।”
মেরি হার্ফ বলেন, “এ দেশের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কোন পথে এগিয়ে যাবে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ যখন তা নির্ধারণ করবে, সে সময় সকল নাগরিক যাতে স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারে সে জন্য তাদের রাজনৈতিক পরিসর দেয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। শান্তিপূর্ণভাবে এবং দায়িত্বশীলতার সাথে এই পরিসর ব্যবহার করার জন্য আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানাই এবং একই সাথে সকল পক্ষের প্রতিও আহ্বান জানাই যাতে তারা সহিংসতা থেকে বিরত থাকে। সহিংসতা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ নয় এবং তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।”
এদিকে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হতাশা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য। বৃটিশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের জ্যেষ্ঠ প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ার্সি এক বিবৃতিতে জানান, অর্ধেকের বেশি নির্বাচনী এলাকায় ভোটাররা ভোটদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং অবশিষ্ট এলাকাগুলোতে ভোটারদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার বিষয়টি হতাশাজনক।
বৃটিশ সরকার ভবিষ্যতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে আরো জানানো হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যদের মতোই যুক্তরাজ্য বিশ্বাস করে যে পরিণত এবং কার্যকর গণতন্ত্রের প্রকৃত স্মারক হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। এতে করে ভোটারদের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলা সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন, স্কুল-কলেজসহ সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ, প্রাণহানি, রাজনৈতিক হয়রানি ও উত্তেজনা বাড়ায় বিবৃতিতে উদ্বেগ ও নিন্দা জানানো হয়।
বিবৃতিতে বৃটিশ সরকার নতুন সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলকে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী উল্লেখ করে ব্যারনেস সাঈদা ওয়ার্সি তার বিবৃতিতে বলেন যে আরো স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য দেশটির জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে, বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলকে উদ্বেগজনক বলে আখ্যা দিয়েছে কানাডা। সোমবার রাতে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন বেয়ার্ড এক বিবৃতিতে বলেন, তার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একীভূত হয়ে বলতে চায় যে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে পুরোপুরিভাবে অংশগ্রহণমূলক করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ঢাকাস্থ কানাডার দূতাবাস এ বিবৃতিটি গণমাধ্যমের কাছে পাঠায়। গণতন্ত্রে ভিন্নমতের সহাবস্থান সব সময়ই থাকতে পারে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য হতাশাব্যঞ্জক।
নির্বাচনকে ঘিরে যে সহিংসতা চলছে সেদিকে কানাডা লক্ষ্য রাখছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় শতশত লোক মারা গেছে। আমরা চাইনা এ সংঘাত দীর্ঘায়িত হোক। রাজনৈতিক মতানৈক্য নিয়ে মৃত্যু অগ্রহণযোগ্য।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি বলেন, সহিংসতা দীর্ঘায়িত হলে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
কানাডা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত উল্লেখ করে সব রাজনৈতিক দলকেই জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
সেই সঙ্গে আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে কানাডীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিবৃতিতে বলেন, আমরা আশা করছি এ বিষয়ে শিগগিরই দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হবে। এর ফলে যে নির্বাচন হবে তার ফলাফল হবে সব বাংলাদেশির কাছেই গ্রহণযোগ্য।