বাংলাদেশের রাজনীতি: দুই মা, দুই ছেলে
ডেস্ক
ঢাকা: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন দুজন মানুষের ওপর নির্ভরশীল। অথচ দুজনের একজনও দেশে থাকেন না।একজন পেশায় প্রকৌশলী। আমেরিকান স্ত্রী আর শিশু কন্যাকে নিয়ে বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যজন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে এখন লন্ডনে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি এখন আইন বিষয়ে পড়াশুনা করছেন বলেও জানা গেছে। আইনের ছাত্রটি এখন তার পরিবারকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে তাদের রাজনৈতিক মিত্র বলে পরিচিত সৌদি আরবের সঙ্গে ছক কষছে। ভবিষ্যতে এ দুজনের একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দুই পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আর তারেক রহমানকে নিয়ে লিখিত নিবন্ধের শুরুটা এভাবেই হয়েছে। শনিবার ‘অল ইন দ্য ফ্যামিলি: বাংলাদেশ পলিটিকস ফোকাসড অন টু মামস, দু সনস’ শিরোনামে লিখিত নিবন্ধটি ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
পত্রিকায় বলা হয়, ৪২ বছরের সজীব ওয়াজেদ জয় হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র। আর ৪৬ বছরের তারেক হলেন বিরোধী দলায় নেত্রী খালেদা জিয়ার জ্যৈষ্ঠ পুত্র। তারা দুজন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান শাহরিয়ার বলেন, ‘এদেশের রাজনীতিতে এ দুজনের প্রভাব অসীম। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দুটি পরিবারের বাইরে থেকে অন্য কারো ক্ষমতার সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে আসা অসম্ভব।’
আগামী বছরের গোড়ার দিকে দেশটিতে যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে সেখানে মায়েদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান দুই ব্যক্তি হলেন তারেক ও জয়। এদের দু জনকে ঘিরে মিডিয়ার কৌতুহল কিছু কম নেই। যদিও কেউ কেউ তাদের রাজনৈতিক তৎপরতাকে অগণতান্ত্রিক হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।কলেজ ছাত্র মাজহারুল ইসলাম বলেন,‘ আমাদের দেশে তো রাজতন্ত্র চলছে না। তাহলে মায়েদের পর তাদের ছেলেরা কেন ক্ষমতায় আসবে? দেশে আমাদের শাসন করার মতো যোগ্য আর কোনো মানুষ কি নাই? এটা তো লজ্জাষ্কর!’
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা বলে কথা। এখানকার দেশগুলোতে পরিবার কেন্দ্রীক গণতন্ত্র চালু রয়েছে। তাই হাসিনা বা খালেদা দলে কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই গত কয়েক দশক ধরে নির্বিঘ্নে দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
শাহরিয়ার আরো বলেন,‘ ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের দিকে তাকান, সবখানে একই অবস্থা। বাংলাদেশে কোনো ব্যতিক্রম নেই। এসব দেশগুলোতে একই পরিবারের সদস্যরা ঘুরে ফিরে ক্ষমতায় আসেন বা ক্ষমতায় আসার জন্য নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে থাকেন।’
কয়েক সপ্তাহ আগে জয় যখন বাংলাদেশে আসেন তাকে তখন একজন রক তারকার মতো বিভিন্ন শহরে অভ্যর্থনা দেয়া হয়। তাকে এক নজর দেখার জন্য বিভিন্ন সড়কের দু পাশে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন দলের কর্মী, সমর্থকরা। তার গাড়িবহরের সঙ্গে অনেককে অংশ নিতে দেখা যায়। এসময় তারা দলীয় শ্লোগানে চারদিক মুখরিত করে তোলে।
ওই সফরে অংশ নেয়া ছাত্ররা জয়কে উদ্দেশ্য করে বলেন,‘ আপনি দেশের ভবিষ্যৎ। আপনি আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা। আমরা সবসময় আপনার পাশে থাকবো।’
হাসিনার সহযোগী মাহাবুবুল হক সাকিল হিন্দুস্তান টাইমস প্রতিবেদককে বলেন, ‘একদিন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর হবেন নাই বা কেন? এটাই তো গণতন্ত্র? জনগণ যদি তাকে চায় অবশ্যই তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন।’
অন্যদিকে জিয়াপুত্র তারেক রহমান আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে দলকে নির্বাচিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদিও তিনি নিজে এখন লন্ডনে বসবাস করছেন। আগামী নির্বাচনে তিনি নিজেও কোনো এক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন। তার মা খালেদা জিয়ার ২০০১-২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তারেক সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তার সুপারিশে মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বলে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়।
খালেদা জিয়া ক্ষমতা ছাড়ার পর আদলতের নির্দেশে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালে দেশ ছাড়েন তারেক।বিদেশ পাড়ি জমানোর আগে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার কারাগারে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
.
তারেক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট। দেশে ফিরলে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে আবারো আটক করার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি কৌঁসুলীদের অভিযোগ, তার মা ক্ষমতায় থাকাকালে তারেক এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে ২০১১ সালে ২.৭৩ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়েছিলেন। অন্য আদালত ২০০৪ সালে হাসিনার মিছিলে গ্রানেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।. ঢাকায় ওই হামলায় কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী হাসিনা।
তবে বিএনপি তারেকের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন, জিয়া পরিবারের সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। খালেদা জিয়া আবারো ক্ষমতায় এলে তার ছেলে তারেকের দেশে ফেরা সহজ হবে।
তারেক এখন দূরে থেকেই মায়ের জন্য কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি লন্ডনের কয়েকটি সভায় বর্ক্তৃতা করেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব সফর করেন।
জামিলুর কাদের নামে তার এক সমর্থক বলেন,‘ এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি বীরের মতো দেশে ফিরবেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের পুত্র। তার মা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমার বিশ্বাস তারেক সকল অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে ফিরে আসবেনে এবং তার প্রতি সুবিচার করা হবে।’
১৯৮১ সালে এক সেনা অভ্যত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর রাজনীতিতে আসেন বেগম খালেদা জিয়া।এর কয়েক বছর আগে ভারত থেকে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। তার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিব এবং তার পরিবার ১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যূত্থানে নিহত হওয়ার বেশ কয়েক বছরর পর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। এই দুই নেদ্রী একসঙ্গে আন্দোলন করে ১৯৯০ সালে সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসেন মো্হাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যূত করে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। এরপর থেকে তারা দু জনই পালাক্রমে বাংলাদেশের নের্তৃত্ব দিয়ে আসছেন।
এখন তারা দুজন দুজনার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। দুজনই এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনারই আশা তাদের পর তাদের ছেলেরা আসেবন ক্ষমতায়।