বঙ্গভবন আর জেলখানার মধ্যে পার্থক্য নেই

04/02/2014 11:14 amViews: 8

 

President  বঙ্গভবন ও জেলখানার মধ্যে তেমন পার্থক্য দেখেন না রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। ষাটের ছাত্র রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে হাতেখড়ি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে এসে এক বর্ণাঢ্য জীবনের গৌরবময় অধ্যায় সঙ্গে নিয়ে এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে বঙ্গভবনে বসে আছেন। সেদিনও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে যার বিচরণ ছিল মানুষ আর মানুষের সঙ্গে। রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের জায়গায় এখন সংবিধান, আইন ও প্রচলিত বিধানবলে অনেকটা হাত-পা বাঁধা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাগ্যে সর্বোচ্চ সম্মান লাভ ঘটলেও এই জীবনকে তার নিয়মে বাঁধা বন্দী জীবন মনে হয়।

 

রবিবার রাতে বঙ্গভবনে তার সঙ্গে বহুদিন পর দেখা। গল্পে গল্পে মনে হলো একটুও বদলাননি ইটনা-মিঠামইনের হাওরজয়ী মাঝি, বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং পার্লামেন্টের অধিবেশন প্রাণবন্ত রাখার কৃতিত্ব অর্জন করা সাবেক স্পিকার আবদুল হামিদ। মাঠের রাজনীতি, বন্ধু-স্বজনদের আড্ডা বা সংসদে যেভাবে গল্প-গুজবে রসবোধের সঞ্চারণ করতেন তার ব্যত্যয় এখনো ঘটে না।

 

আলাপে আলাপে বললেন, কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গভবনে গেলে তিনি মুজিবকন্যাকে বলেছিলেন-  ড. শিরীনকে এখানে রেখে দিন, আমাকে সংসদেই পাঠিয়ে দিন। উত্তরে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, তার চেয়ে আমি এখানে থেকে যাই, আপনি আমার জায়গায় চলে যান। শিরীনকে সরিয়ে লাভ কী? নীরব থাকেননি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। চিরচেনা হাসিটুকু দিয়ে বলেছেন, আপনার দায়িত্ব আমার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। আপনি ভোররাতে ওঠেন, নামাজ পড়েন, তিলাওয়াত করেন, পত্রিকা পাঠ করেন, সাতসকালে কার্যালয়ে ছোটেন, নানান কর্মসূচিতে অংশ নেন; সেই সঙ্গে রয়েছে মন্ত্রিসভার বৈঠক। এত সকালে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত যে কোনো কাজ করাতে পারবেন। সকালে আমার ঘুমানোর সময়। তিনি আরও বলেন, জীবনে মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি সকালে অফিসে ছুটতে হবে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে হাজিরা দিতে হবে বলে।

 

দিলখোলা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কথা-  রাত আড়াইটা-তিনটায় শয্যায় গিয়ে দুপুর বেলা ঘুম থেকে উঠে দুইটা-আড়াইটায় বঙ্গভবনের অফিস কক্ষে আসেন। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি না থাকলে এটাই তার দৈনন্দিন রুটিন। অফিসে এসে ফাইল সই, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলিয়ে কাজ দ্রুতই ফুরিয়ে যায়। এত বড় বঙ্গভবনে দর্শনার্থীরাও আসতে চায় না। রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদে অধিবেশন না থাকলেও স্পিকারের অফিসে বসে সবাইকে ডেকে এনে গল্প-গুজবে মেতে উঠতেন। সময় তার মহা আনন্দে কাটত।

 

কী সংসদ, কী বাসভবন। প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যেতেন। তিনি জানালেন, মন বড় টানে হাওরের স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাই। ইটনার গ্রামের বাড়িতে পাঁচটি দিন থেকে আসি। কিন্তু, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষী মিলিয়ে ৬০০ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ছন্দপতন ঘটিয়ে যাওয়াটা নিজের কাছে বড়ই বিব্রতকর। মন টানলেও তার বাড়ি যাওয়া হয় না। ঢাকা নগরীতে অনেক স্বজনের বিয়েশাদি বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণেও যান না দুই কারণে। এক. রাস্তাঘাট আটকে পথচারীদের জন্য বিড়ম্বনা তৈরি করা ও দুই. ওই স্বজনের বাড়িতে আগত মেহমানদের নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হওয়া তাকে বিব্রত করবে বলে। যেখানে একেবারে না গেলেই নয় সেখানে তিনি তার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন।

 

বঙ্গভবনে তার কিশোরগঞ্জের মানুষ দেখা করতে আসেন। দর্শনার্থীরাও আসেন। মেহমান এলে খুব খুশি হন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বললেন, সময় কেটে যায় গল্পে-আড্ডায়। অবসরে বই, সংবাদপত্র আর টেলিভিশন দেখেন নিয়মিত।

 

বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানেও নাকি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ খোলামেলাভাবে বলেছেন, জেল আর বঙ্গভবনের মধ্যে তিনি খুব একটা পার্থক্য দেখেন না। জেলখানায় সরকারি খাবার খেতেন, বঙ্গভবনেও সরকারি খাবার খান। তবে জেলখানার খাবার ছিল নিুমানের, বঙ্গভবনেরটা উন্নতমানের। জেলখানায়ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার, বঙ্গভবনেও নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী। জেলখানাটা অনেক বড়, বঙ্গভবনটাও অনেক বড়। জেলখানায়ও দর্শনার্থী গেলে ভালো লাগত, এখানেও দর্শনার্থী এলে ভালো লাগে। জেলখানায় নিরাপত্তারক্ষীরা স্যালুট দিত না, বঙ্গভবনে নিরাপত্তারক্ষীরা স্যালুট দেয়-  এই যা পার্থক্য। তার রসিকতায় সবাই হাসেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বঙ্গভবনের স্টাফরাও প্রাণবন্ত থাকেন।

 

নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংকটকালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া জোট নেতাদের নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন দাবিনামা নিয়ে। রাষ্ট্রপতিকে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই যদি খালেদা জিয়া চলে যান এ কারণে শুরুতেই বললেন, আমার এখানে এসেছেন, আগে চা-নাশতা করুন, তারপর আলোচনা করা যাবে।

 

খাওয়া শেষে বেগম খালেদা জিয়ার দাবিনামা হাতে নিয়ে তিনি বললেন, আপনার আর প্রধানমন্ত্রীর এক জায়গায় দারুণ মিল আছে! শুনেই বেগম খালেদা জিয়া নড়েচড়ে বসে জানতে চাইলেন-  মিল মানে? উত্তরে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে রাষ্ট্রপতি তাকে বললেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটা ছিনিয়ে নেওয়া যায় সে ব্যাপারে আপনারা দুজনই একমত হয়ে তা করেছেন। এমনকি সংসদে রাষ্ট্রপতি যে বক্তব্য দেবেন সেখানে তার একটি ভাষা বা শব্দ ব্যবহারেরও সুযোগ রাখেননি। রাষ্ট্রপতির ভাষণ আপনারাই তৈরি করেন, আপনারাই মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করেন। রাষ্ট্রপতি শুধু নিয়ম রক্ষায় সংসদে দাঁড়িয়ে তা পাঠ করেন। রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন না। ভাষণ পাঠ করেন।

 

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেদিন খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে পঙ্গু বানিয়ে রেখেছেন। একজন পঙ্গু মানুষের কাছে কী চাইতে পারেন, আর কীইবা দিতে পারে! রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সতীর্থরা শুধু হেসেছিলেন। আবদুল হামিদ সেদিন খালেদা জিয়াকে শুধু এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে আপনার দাবি আমি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেব। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।

 

সেই সময়ে সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনও সিভিল সোসাইটির বিশিষ্টজনদের নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেওয়া স্মরণ করিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে আপনি ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে পারেন। উত্তরে সংবিধান খুলে বিনয়ের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের একসময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘কামাল ভাই, সংবিধানটা তো আপনিই তৈরি করেছেন। সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রাখার শপথই তো আমি নিয়েছি। আমারে দেখান তো শপথ অনুযায়ী সংবিধানের কোন জায়গায় সুযোগ আছে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার?’

 

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মনে করেন তবুও মাঝেমধ্যে সবাই গেলে অন্তত তাদের সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎটুকু হয়। এতে তিনি আনন্দও পান। সঙ্গে ছিল অনুজ, সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ও সমাজকর্মী হাজী হেলাল।

 

পীর ফজলুর রহমান গল্পে গল্পে হাওর অঞ্চলের চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরলে দেখা গেল হাওরের রাজপুত্র আবদুল হামিদ সব খবরই রাখেন। হাওরের অকাল বন্যা, কৃষকের বুক ভেঙে যাওয়া, হাওররক্ষা বাঁধ নিয়ে অনিয়ম-  কোনো কিছুই তার নজরের বাইরে নয়। হাওরের মানুষের কথা খুব ভাবেন। পাহাড়ি ঢলে আসা পলিমাটিতে হাওরের যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অনেকটাই উদ্বিগ্ন দেখাল। নবীন এমপিকে বললেন, আপনারা সংসদে কথা বলেন। হাওর অঞ্চলের কত প্রজাতির মাছ এখন হারিয়ে যাচ্ছে, জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে।

 

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকলেও ১৯৭০ সাল থেকে বারবার বিজয়ী পার্লামেন্টারিয়ান দুবারের স্পিকার ও সাবেক বিরোধীদলীয় উপনেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের মনটা যেন সংসদেও পড়ে থাকে। নবীন এমপিকে বললেন, স্পিকারের আসনে যিনি বসেন একজন সংসদ সদস্যের বক্তব্যের সঙ্গে কোনো প্রশ্ন উঠলে জবাবটা সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া জরুরি। সংসদ পরিচালনায় একটু চুটকি, একটু রসিকতা না থাকলে অধিবেশন প্রাণবন্ত হয় না।

 

তিনি মনে করেন, একজন সংসদ সদস্যকে দক্ষতা অর্জন করতে হলে প্রথমেই অধিবেশনে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে এবং মনোযোগের সঙ্গে অগ্রজ বা সহকর্মীদের বক্তব্য ও বিতর্ক শুনতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়মিত সংসদের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে বই আর রেফারেন্সে ডুব দিতে হবে। সংসদ কার্যপ্রণালি বিধি ও সংবিধান পাঠ করলেই চলবে না, তা আয়ত্তের মধ্যে নিতে হবে।

 

উঠে আসার আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনের গরম পিয়াজু, চপ, কেক ও বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করালেন। বললেন, মাঝেমধ্যে দেখতে আসবেন। আপনারা ভালো থাকবেন; দেশ ও মানুষের কল্যাণে জীবনের দীর্ঘ সময় সক্রিয় রাজনীতি করেছি, জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় দেশ ও মানুষের শান্তি আর কল্যাণ চাই। রাজনীতি থেকে এখন অনেক দূরে থাকলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশ এবং জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নে যতটুকু ভূমিকা রাখার ক্ষমতা রয়েছে ততটুকু রেখে যেতে চাই। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।

 

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন-পীর হাবিবুর রহমান
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Leave a Reply