বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কেমন হতো? বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

02/06/2017 12:06 pmViews: 147

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কেমন হতো?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এবার ১৫ আগস্ট সখিপুরে ছিলাম। এর আগে ১৫ আগস্ট কখনো সখিপুরে থাকা হয়নি। ইল্লি-দিল্লি-ঢাকা-টাঙ্গাইল কত জায়গায় থেকেছি। কিন্তু সখিপুরে থাকিনি। শোক দিবসের মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভায় দলীয় কর্মী ও জনসাধারণের অসম্ভব সাড়া দেখেছি। মন ভরে গেছে লোকজনের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণে। ইদানীং মায়া-মমতা, তাপ-সন্তাপ কারো মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। তার ব্যতিক্রম দেখলাম সখিপুরে। সেদিন এক আওয়ামী লীগের পাতি নেতা যে কয়েক বছর আগেও ভাঙা খোড়ায় চা খেত, আমার বাড়ির সামনে লাশ দেখতে এসে দেখা করে গেছে। শুনলাম সে নাকি দুই গরু জবাই করে শোক দিবস পালন করেছে। এ তো শোক নয়, এ যেন আড়ম্বর। ১৫ আগস্ট জাতির চরম বেদনার দিনে আমি কাউকে দেখানোর বা নাম জাহির করার জন্য কোনো দিন কোনো কিছু করিনি। টুঙ্গিপাড়ায় যা করেছি তা আত্মার টানেই করেছি। শুনলাম ঢাকা শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে লাখ লাখ টাকার বাজেট। যে যত সংগ্রহ করতে পারবে সেই তত বড় কুতুব। এ তো বেদনা বা শোক নয়, যেন উৎসব! বুক ফেটে যায়! ১৫ আগস্ট জাতির পিতার লাশ যখন ধানমন্ডিতে পড়েছিল, কাঁদার লোক ছিল না। কিন্তু আজকাল যেন এক প্রতিযোগিতা চলছে। আজকাল লাশ দেখার বয়ান করেও অনেকে হিরো সাজতে চান। ছোট্ট কাজের ছেলে রমা, যে হত্যার সময় ওখানেই ছিল। হত্যার পরপরই দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেবা করেছে। সকাল বিকেল তার সাথে কথা হয়েছে। কে কোথায় মারা গেছে, কার লাশ কোথায় ছিল, কতবার শুনেছি তার হিসাব নেই। সেদিন দেখলাম কামালের লাশ কে একজন তার কলমের এক খোঁচায় নিচ থেকে দোতলায় তুলে দিয়েছে। ইদানীং সবই সম্ভব! মরাকে তাজা, তাজাকে শূন্যে তোলা- এসব উপন্যাসে সম্ভব। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যা কোনো উপন্যাস ছিল না। সে ছিল বড়ই বেদনাদায়ক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখা যেতে পারে, কিন্তু তার হত্যা নিয়ে নয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রে তেমনটাই হচ্ছে।
দেখতে দেখতে ৪০টা বছর জীবন থেকে চলে গেল, মনে হয় এ যেন সেদিন। বঙ্গবন্ধু চলে গিয়ে আমাদের শেষ করে দিয়েছেন। যে যায় তার তো আর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না, যারা থাকে তারা বোঝে। বঙ্গবন্ধু নেই আমাদের কিছুই নেই। অথচ তার জীবদ্দশায় তার জীবন যারা দুর্বিষহ করে তুলেছিল, তারা আজ কী প্রতাপেই না আছে! আর যারা তার জন্য জীবন কয়লা করেছে তাদের অবস্থা কী? যদিও আজ যারা প্রদীপের আলোয় ঝলমল করছে, প্রদীপ নিভে গেলে অন্ধকারে তাদেরও মুখ দেখা যাবে না। তবু খারাপ লাগে, যাদের জন্য দেশের এই পরিণতি তাদের শাস্তি হলো না। যারা জাতির পিতাকে ব্যর্থ করতে আদাজল খেয়ে চেষ্টা করেছে তারা রাজনৈতিকভাবে শুধু চাটুকারী করে বিরাট জায়গা করে নিলো। ভাবতে কষ্ট হয়! বিশেষ করে যখন টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে যাই, তখন বড় বেশি খারাপ লাগে। সর্বত্র জিঘাংসা। বুক চিতিয়ে সাহস করে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতেও বাধা। বঙ্গবন্ধুর ৪০তম মৃত্যুদিনে ভেবেছিলাম সবার কিছু-না-কিছু চৈতন্য হবে। কিন্তু না। সাধারণ মানুষ কিছু শিখলেও হৃদয়ঙ্গম করলেও অসাধারণেরা তার ধারেকাছেও যান না। বেগম খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ করেছিলাম শোকের দিনে ঘটা করে জন্মদিন পালন করবেন না। একবার আলোচনায় তিনিও বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে তার জন্মদিন পালন করতে তেমন ভালো লাগে না। দলীয় কর্মীরা জোর জবরদস্তি করে করলে তিনি কী করবেন। কিন্তু কেন যেন এবার আর তার কথা অতটা বিশ্বাস করতে পারছি না। সেদিন লিখেছিলাম ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়া’, বিএনপি নেত্রী লিখিনি। দেশনেত্রী হতে হলে শুধু বিএনপির মনমানসিকতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, জেদের কথা ভাবলে চলবে না। দেশের নিরাসক্ত লাখ লাখ মানুষের মন মেজাজের কথাও ভাবতে হবে। নিশ্চয়ই বেগম খালেদা জিয়া একদল মানুষের নেতা হতেই পারেন। কিন্তু দেশের নেতা হতে হলে তার বিরোধীদের ওপরও প্রভাব থাকতে হবে। অন্ততপক্ষে তিনি যে একজন বিবেকবান, ন্যায়পরায়ণ মানুষ, শত্র“ও তার কাছে নিরাপদ এবং ন্যায়বিচার পেতে পারেÑ এ বিশ্বাস মানুষের মনে জাগতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এটা করেছেন, ওটা করেছেনÑ এসব বলে হয়তো বিএনপি নেত্রী হওয়া যাবে, দেশনেত্রী হওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী, তিনিও জাতীয় নেতার আচরণ করেন না। তার আচরণেও প্রচুর সঙ্কীর্ণতা থাকে। দেশের নেতা হিসেবে সমগ্র দেশের প্রতি তার যে দায়িত্ব কর্তব্য সেটা অনেক সময় ভুলে যান। হিংসা, প্রতিহিংসা অনেক সময় তাকে প্রায় অন্ধ করে ফেলে। তা না হলে ১৫ আগস্টের প্রতিরোধ সংগ্রামীদের খোঁজখবর নিতে পারতেন, আমাকে একটা ফোন করতে পারতেন, জিজ্ঞেস করতে পারতেন মরে গেছি না বেঁচে আছি। টুঙ্গিপাড়ায় তার বাড়িতে এক রাত আমার ছেলেমেয়ের থাকার জন্য চিঠি দিয়েছি। আজো কোনো খবর পাইনি। কী হলো, না হলো তিনিই জানেন। তাকে লিখতে যেতাম না, রেহানার সাথে কথা হলেই বলে ওসব বাড়িঘর শুধু আমাদের নয়, ওগুলো আপনারও বাবার। ওগুলোতে আপনারও দাবি আছে। কী করে যে রেহানা অমন জাদুকরী কথা বলে, ভেবে পাই না। যেহেতু দেশে শান্তি সুস্থিতি চাই, সেহেতু শান্তি সুস্থিতি যে হিংসার মাধ্যমে আসবে না তা জানি। এজন্য চরম সৌহার্দ্য দরকার। আর সেই সৌহার্দ্যরে জন্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রয়োজনÑ এটা কাউকে বলে দিতে হবে না। যাদের মাথায় রক্ত উঠেছে সে রক্ত আবার হৃৎপিণ্ডে ফেরার আগে তারা যে শান্ত হবে না, সুস্থির হবে না এটা তো বিজ্ঞানের কথা। শুনলাম আগামীতে বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়া শোকের দিনে জন্মদিন পালন থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। তা তিনি করতেই পারেন। জনাব আজমের মতো যখন উপদেষ্টা তখন অমন ভাবায় দোষ কী? কিন্তু আগামী মহারণে এই কৌশল আদৌ কোনো কাজে আসবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
একটা জাতির জন্য ৪০তম শোক দিবস তেমন বড় কিছু না হলেও কোনো ব্যক্তিজীবনে চাট্টিখানি কথা নয়। দেখতে দেখতে ৪০টা বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেল, মানুষের কোনো কাজেই লাগলাম না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এক অন্ধ ভালোবাসায় দেখতে দেখতে খেলতে খেলতে দিনগুলো শেষ করে দিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে আদর্শে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন, মানুষকে সাহসী করতে চেয়েছিলেন, আত্মমর্যাদায় ভরপুর একটি জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন তার কিছুই হলো না। গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যিনি জীবন দিয়েছেন, সেই গণতন্ত্রই যখন নেই তখন কী করে নেতার আত্মা শান্তি পাবে? বর্তমান আওয়ামী সরকার যেমন গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে আছে, যারা আগে ছিলেন তারাও শুধু লেজ ধরে টানাটানি করেননি, তারাও মাথা কেটে ফেলতে চেয়েছেন। দলে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে গণতন্ত্র থাকে না। আর গণতন্ত্র বাজারে কেনা যায় না। গণতন্ত্রের জন্য আত্মমর্যাদাশীল মানুষের প্রয়োজন। গণতন্ত্রে প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা থাকে। নিজের অন্যায় ন্যায়, অন্যের ন্যায়ও অন্যায়- এমনটা গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের প্রথম এবং প্রধান উপাদান সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, সাহসিকতা। এর একটাও দুর্বল হলে গণতন্ত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। পিতার মৃত্যুদিনে লম্বা ৪০ দিনের শোক পালনের মহড়া দেখে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত চৌচির হয়ে গেছে। ৪০ দিনে এত কিছু হচ্ছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যায় যারা প্রতিবাদ করেছিল তাদের খবর নেয়ার কেউ নেই। গ্রামগঞ্জে দেখেছি, কারো সন্তান পানিতে পড়লে কেউ যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করে সে পরিবার আজীবন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। কিন্তু সমাজের উঁচুতলায় কৃতজ্ঞতার লেশ নেই। কতদিন ঘরের বাইরে আছি তাই ধানমন্ডির বাড়ি গিয়েছিলাম। পায়ে পায়ে কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না। বাড়ির এ দিক সে দিক ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল কোথায় ৪০ বছর? এ যেন এই সে দিন মধ্যরাতে এসেছিলাম। পিতার সাথে শেষ কথা শেষ দেখা হয়েছিল। সেদিন আর এদিন কত তফাৎ! আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: ৪০ বছর বয়সে নবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার ওপর আল্লাহর ওহি নাজিল হয়েছিল। আশায় আছি আমাদের অমানিশার অন্ধকার ঘোচে কি না। আমরা আবার আলোর দিশা পাবো কি না। দয়াময় আল্লাহ যেন নেতা, পিতা, বন্ধু, ভাই হিসেবে তাকে বেহেশতবাসী করেন। আমিন।

Leave a Reply