বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরাতে সহযোগিতা করছে না যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও পাকিস্তান
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরাতে সহযোগিতা করছে না যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও পাকিস্তান
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পাকিস্তানে খুনিরা আশ্রয়ে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যারা নিজেদের সভ্য ও উন্নত দেশ হিসেবে দাবি করে, তারাই এসব ঘৃণ্য ঘাতকদের আশ্রয় দিয়েছে। কেন আমেরিকা ও কানাডার মতো দেশ এটা করছে তা আমার জানা নেই। ওইসব দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি, কিন্তু তারা কোন সহযোগিতা করছে না। যে কোন কারণেই হোক আমাদের সহযোগিতা করছে না এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। এটা দেশবাসীর জানা দরকার। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, কয়েকজনের রায় কার্যকর করা হয়েছে। খুনিদের মধ্যে যারা বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, খুনি খুনিই, সে যেখানেই থাকুক। আমরা অনেকবার সেসব দেশের সরকারের কাছে খুনিদের ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করেছি, তারা দেয়নি। আমাদের চেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আমরা কূটনৈতিক ও আইনগতভাবে খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বুধবার সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের মধ্যে ২ জন আমেরিকায়, ১ জন কানাডায়, ২ জন লিবিয়ায় ছিল, পরে পাকিস্তানে গেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, তারা পাকিস্তানে আছে। যদিও পাকিস্তান সরকার তা স্বীকার করে না। এ প্রসঙ্গে ওয়ান-ইলেভেনের সময় চ্যানেল আইয়ে খুনি রশিদের সাক্ষাৎকার প্রচারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রা যে চালায় সেই জিল্লুর খুনি কর্নেল রশিদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার এনেছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে খুনি রশিদ কোথায় আছে। তবে জেনেছি, খুনি রশিদ ওই সময় লিবিয়ায় থাকলেও এখন পাকিস্তানে রয়েছে। বাকি দুই খুনি কোথায় পালিয়ে রয়েছে সেই তথ্য আমরা এখনও জানতে পারিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর যারা উল্লসিত হয়েছিল তারা স্বাধীনতার শত্রু, পরাজিত শক্তির পদলেহনকারী। বাঙালির বিজয় যারা মেনে নিতে পারেনি তারাই উল্লসিত হয়েছিল। আর পুরো বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল তাদের সবকিছুকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি আমৃত্যু ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে নেই যে খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে বিচার বন্ধ করা হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমানরা তাই করেছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও প্রাণনাশের চেষ্টা প্রসঙ্গে বলেছেন, যে দেশে খুনিদের পুরস্কৃত ও দায়মুক্তি দেয়া হয়, সে দেশে আমার পদে পদে বাধা ও আঘাত আসবে এটা আমি জানি। কিন্তু আমি মৃত্যুকে ভয় করি না, ঘাতকদের পরোয়া করি না। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি রাজনীতি করি। তাই আমার জীবন দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। আল্লাহ্ ছাড়া জীবনে কখনও কারো কাছে মাথানত করিনি, করবোও না। যত বাধাই বা আঘাতই আসুক, আমি ভয় করি না, ভয় পাই না। আল্লাহ্ যতদিন বাঁচিয়ে রাখবেন দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাব। স্বতন্ত্র এমপি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী ও হাজী মোহাম্মদ সেলিমের পৃথক দু’টি সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি সততা, দৃঢ়তা ও আদর্শ নিয়ে কাজ করলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। আমি সেই লক্ষ্য নিয়েই চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু ঊর্ধ্বে থেকে নির্মোহভাবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। তাই কেন ভয় পেতে যাব? ঘাতকদের পরোয়া করবো? তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্বল্পমূল্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী সরবরাহের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় যতো ভাষণ, স্বাধীনতা পরবর্তী ভাষণ, কারাবন্দি থাকাবস্থায় লেখা ডায়েরিগুলো সংগ্রহ করে বড় ধরনের ডকুমেন্টারি করার কাজ চলছে। শিশুদের জন্যও কমিকস আকারে ছোট ছোট বই বের করে নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কাজ চলছে। অতিরঞ্জিত নয়, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা সম্পর্কে সঠিক তথ্যগুলো আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ পরবর্তী ২১টি বছর বঙ্গবন্ধুর নাম অনেকটাই নিষিদ্ধ ছিল, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে কয়েকটি প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছে। পরাজিত শক্তির আদর্শ শেখানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো এবং ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাজাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাসকে কখনও মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। ঘাতকরা ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলেও আদর্শিক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি। বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, চির জাগরুক।
মোশ্তাক-জিয়া বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকারী
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, খুনি মোশ্তাক ও তার দোসর জিয়াউর রহমান ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ড চালায়। এরপরই দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই জিয়াই আমাদেরকে দেশে ফিরতে দেয়নি, এমনকি ধানমন্ডির বাড়ি ও ৩২ নম্বর সড়কের নম্বরও বদলে দেয়। সরকারি দলের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ৩০শে জুলাই আমি ও শেখ রেহানা জার্মানিতে রওনা হই। ১৫ দিনের মাথায় শুনি আমরা দুই বোন এতিম হয়ে গেছি। নিঃস্ব ও রিক্ত হয়ে গেছি। আমি এখনও মাঝে-মধ্যেই ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে যাই। আমার সকল ব্যথা-বেদনা সহ্য করার শক্তি আর বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্য কাজ করার প্রেরণা সঞ্চয় করার জায়গা এটা। এই বাড়ি থেকেই যেন শক্তি পাই। একদিকে সব হারানোর বেদনা, অন্যদিকে মানুষের সেবা করার প্রেরণা- সবই ধানমন্ডির এই বাড়িতে এলে পেয়ে থাকি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ই আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে আমার পিতা-মাতা, ভাইসহ পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের জীবনে যেমন এই দিনটি একটি কালো দিন, তেমনি বাংলাদেশের জনগণের জীবনেও নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর পুরো বাংলাদেশই কয়েদ খানায় পরিণত হয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পালা শুরু হয়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়া আমাদের দু’বোনকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়। ৭৫-৮১ পর্যন্ত আমাদের বিদেশের মাটিতেই পড়ে থাকতে হয়। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি। বাংলাদেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মীবাহিনী সকল বাধা উপেক্ষা করে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু দেশে ফিরলেও আমাকে ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পিতা-মাতা, ভাইদের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগও দেয়া হয়নি। বাড়ির সামনের রাস্তার ওপর বসে পড়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়ি।
তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম
সরকারি দলের সংসদ সদস্য তাজুল ইসলামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, ঢাকা থেকে লাকসাম হয়ে চট্টগ্রাাম সরাসরি যাতায়াতের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের রেলপথের দূরত্ব হ্রাস পাবে। তখন ৩ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সুষ্ঠু পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ বার্ষিক মাথাপিছু গড় জাতীয় আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা নিম্নআয়ের দেশ হিসেবে থাকতে চাই না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালীন সময়ে পরবর্তী পাঁচ বছরে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করে আমরা আমাদের ঘোষিত রূপকল্প- ২০২১ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবো ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। রূপকল্প-২০২১ আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্থাৎ ২০৪১ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথ দেখাবে।