ফ্ল্যাট বাসায় জাল টাকার টাকশাল!
ফ্ল্যাট বাসায় জাল টাকার টাকশাল!
২৮ জুন ২০১৫,রবিবার
আব্দুর রহিম শেখ। ২০০৩ সালে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন কাজের সন্ধানে। কাজ শুরু করেন ট্রাকের হেলপার হিসেবে। এরপর তার পরিচয় হয় জাল টাকার কারিগর হুমায়ুনের সাথে। সেই সূত্র ধরেই চলতে থাকেন আব্দুর রহিম। একটু আধটু করে শিখতে থাকেন জাল টাকা তৈরি ও কারবারি। এরপর নিজেই জালটাকার কারিগর বনে যান। কারিগর হয়েই থেমে থাকেননি তিনি। নিজের নেতৃত্বে গড়ে তুলেন একটি চক্র। রাজধানীতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে গড়ে তুলেন জাল টাকার টাকশাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এই অসাধু কারবারী ধরা পড়ে র্যাবের গোয়েন্দা জালে।
রাজধানীর বনশ্রীর একটি ফ্ল্যাট বাসা থেকে জাল টাকা তৈরির মূল হোতা আব্দুর রহিম শেখ ও তার দুই স্ত্রীসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব -৩ এর একটি অভিযানিক দল। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন- আব্দুর রহিমের প্রথম স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৪) ও দ্বিতীয় স্ত্রী রুবিনা খাতুন (১৯) এবং দুই সহযোগী মোহাম্মদ আসাদ (২২) ও তাজিম হোসেন (২৬)। আজ সকাল ৬টার দিকে বনশ্রীর কে ব্লকের ১৬ নম্বর রোডের ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ দুপুরে র্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে জাল টাকা তৈরি চক্রটির তৎপরতা অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। তাই র্যাবের গোয়েন্দা দল এ চক্রকে সনাক্তে তদন্তে নামে। তারই ধারাবাহিকতায় ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে জাল টাকা তৈরি চক্রের মূল হোতা আব্দুর রহিম শেখসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে নগদ ১ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার জাল টাকা, ১১টি টাকা তৈরীর স্ক্রীন, ৩টি বোর্ড, ২টি বিশেষ ডট কালার প্রিন্টার, ২টি ল্যাপটপ, ৪ রোল টাকার ভিতরের নিরাপত্তা সুতার ফয়েল, ২ কৌটা টাকার জলছাপে ব্যবহৃত আইপিআই প্রিন্ট্রিং কালি, ২০০টি প্রিন্টারের কার্টিজ, ১ বোতল রেডোসার কেমিক্যাল, ৮ রীম টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজ, ১টি টাকা স্ক্যানার, ১টি লেমিনেটিং মেশিন এবং ২টি টাকা কাটিং গ্লাস উদ্ধার করে। এছাড়াও তাদের কাছ থেকে ভারতীয় রুপী তৈরীর জন্য ভারতীয় রুপীর নিরাপত্তা সূতা সম্বলিত ফয়েল জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, আব্দুর রহিম শেখ ২০০৩ সালে পিরোজপুর হতে ঢাকায় আসে এবং তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডে হেলপার হিসেবে শুরু কাজ করে। পরবর্তীতে সে ২০০৮ সালে সেখানে কর্মরত অবস্থায় অসাধু জালটাকা তৈরি চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে। ওই চক্রটি মোহাম্মদপুরের জালটাকা তৈরির কারিগর ও চক্রের মূল হোতা হুমায়ুন দ্বারা পরিচালিত হতো। আব্দুর রহিম ওই চক্রের কাছ থেকে জালটাকা সংগ্রহ করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করতো। ইতিমধ্যেই আব্দুর রহিম শেখ উক্ত চক্রের মূলহোতা হুমায়ুনের সান্নিধ্যে থেকে তার আস্থা অর্জন করে জালটাকা তৈরির সকল প্রকার কারিগরী বিদ্যা হাতেকলমে শিখে নেয়। এরপর আব্দুর রহিম নিজেই ল্যাপটপ ও প্রিন্টার কিনে ঢাকার বনশ্রী আবাসিক এলাকায় নিরিবিলি একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে জাল টাকা তৈরির রমরমা ব্যবসা শুরু করে।
মুফতি মাহমুদ জানান, এ কাজে আব্দুর রহিম তার উভয় স্ত্রীকে নিয়োগ করে এবং প্রায়ই গ্রামের বাড়ি থেকে নিকট স্বজনদের মধ্যে থেকে মহিলা নিয়ে এসে উক্ত কাজে নিয়োগ করতো।
তিনি আরও জানান, আব্দুর রহিম জাল টাকা তৈরির কাজে ব্যবহৃত টিস্যু কাগজ ঢাকার বাবু বাজার হতে, টাকার ভিতরের নিরাপত্তা সূতার ফয়েল চকবাজার, স্ক্রীন ও বোর্ড মালিটোলা, রেডোসার ক্যামিক্যাল মালিটোলা ও আইপিআই প্রিন্ট্রার কালি পল্টন থেকে সংগ্রহ করতো।
জাল টাকা তৈরির বিবরন দিতে গিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুর রহিম জানায়, টাকা তৈরির জন্য প্রথমে টিস্যু কাগজের এক পার্শ্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি স্ক্রীনের নিচে রেখে গাম দিয়ে ছাপ দিতো। এরপর ৫০০ ও ১০০০ লেখা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের ছাপ দিতো। অতপর অপর একটি টিস্যু পেপার নিয়ে তার সাথে ফয়েল পেপার থেকে টাকার পরিমাপ অনুযায়ী নিরাপত্তা সূতা কেটে তাতে লাগিয়ে সেই টিস্যুটি ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি জলছাপ দেয়া টিস্যু পেপারের সাথে গাম দিয়ে সংযুক্ত করে দিতো। এভাবে টিস্যু পেপার প্রস্তুত করে বিশেষ ডট কালার প্রিন্টারের মাধ্যমে ল্যাপটপে সেইভ করা টাকার ছাপ অনুযায়ী প্রিন্ট করা হতো।
তিনি জানান, ওই টিস্যু পেপারের উভয় সাইট প্রিন্ট করা হতো এবং প্রতিটি টিস্যু পেপারে মোট ৪ টি জাল টাকার নোট প্রিন্ট করা হতো। এরপর প্রিন্টকৃত টিস্যু পেপারগুলো কাটিং গ্লাসের উপরে রেখে নিখুঁতভাবে কাটিং করা হতো। পরবর্তীতে কাটিংকৃত জাল টাকাগুলো বিশেষভাবে বান্ডিল করে আসাদ ও তাজিম হোসেনসহ আরও ৫/৬ জন প্রতারকের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো।
র্যাব জানায়, এ চক্রটির কাছ থেকে টাকা তৈরির যে পরিমান খালি টিস্যু পেপার ও সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে তা দ্বারা আরো ১০ কোটি টাকা মূল্যের অধিক জালটাকা তৈরি করার পরিকল্পনা ছিলো বলে জানা যায়। এছাড়াও উক্ত টাকা ছাপানোর পাশাপাশি ঈদের পর থেকে ইন্ডিয়ান জাল রুপি ছাপানোর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিলো চক্রটি।