ফিরে দেখা-২০০১ : বরিশালের সংখ্যালঘুদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ফের আতংক
খোকন আহম্মেদ হীরা : আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুশূন্য হতে শুরু করেছে বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বাবুগঞ্জ, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকা। ইতোমধ্যে ওইসব এলাকার অসংখ্য নারী-পুরুষেরা বিভিন্ন অযুহাতে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। নির্বাচনের আগে ও পরে কিংবা নির্বাচনের সময়ে সহিংসতার আশঙ্কায় উৎকন্ঠা ও আতংকের মধ্যে রয়েছেন দেশে থাকা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনে। বিগত বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে নির্মম সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের পর থেকেই আতংককে সঙ্গী করে দিন কাটিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনে।
এরইমধ্যে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর পরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ওপর বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্যাডারদের হামলা, মামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, খুন ও লুটের বিশ্বব্যাপী আলোচিত ঘটনার তদন্তে গঠন করা হয় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত কমিশন’। ওই কমিশনের কাছে সরাসরি ঘটনার বর্ণনা ও লিখিত অভিযোগ দায়ের করার দীর্ঘ তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সরকারের শেষ সময়ে এসে চলতি বছরের জুলাই মাসে নির্যাতিতদের মামলা গ্রহন করতে স্ব-স্ব থানার ওসিদের নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেলার বানারীপাড়া ও আগৈলঝাড়া থানায় কয়েকটি মামলা রেকর্ড করার পর আসামিদের গ্রেফতারও করা হয়েছিলো। কয়েকদিন যেতে না যেতেই আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। ফলে নির্যাতিতদের মাঝে আরো আতংক বেড়ে যায়। ফলে নির্বাচনের পর কিংবা আগে আবারো হামলার আশংকায় আগে ভাগেই দেশ ছাড়তে শুরু করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষেরা।
বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারি ইউনিয়নের দত্তপাড়া গ্রামের ঠাকুরবাড়ির বাসিন্দা সমীর চক্রবর্তীর পুত্র বাপ্পী চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ের (২০০১ সালে) নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বানারীপাড়ার বহুল আলোচিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনকারী সশস্ত্র টাইগার বাহিনী দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে ফের সক্রিয় হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা এলাকার সংখ্যালঘুদের কাছে চাঁদাদাবিসহ পূর্ণরায় জুলুম অত্যাচার শুরু করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ওই বাহিনীর সক্রিয় সদস্য সোহেল বেপারী ও রিয়াজ উদ্দিনসহ তাদের ৮/১০ জন সহযোগীরা গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে তাকে মারধর করে সাথে থাকা নগদ অর্থ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা তার কাছে ৩০ হাজার টাকা চাঁদাদাবি করে। বাপ্পী আরো অভিযোগ করেন, সন্ত্রাসীদের বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে তারা (সন্ত্রাসীরা) প্রকাশ্য দিবালোকে সশস্ত্র অবস্থায় তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে দাবিকৃত চাঁদার টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এসময় চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় সন্ত্রাসীরা তাকে (বাপ্পীকে) মারধর করে তাদের বসত ঘর ভাংচুর করে। এ ঘটনার পর বাপ্পী তার পরিবারের দু’জনকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরপূর্বে উল্লে¬খিত সন্ত্রাসীরা একইবাড়ির সঞ্জু চক্রবর্তীকে চাঁদার দাবিতে মারধর করে। সন্ত্রাসীদের অপহরনের হুমকির মুখে সঞ্জুর স্কুল পড়–য়া মেয়ে ও বোনকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সূত্রমতে, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে (২০১০ সালের ১২ এপ্রিল) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ শাহাবুদ্দিন, সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মনোয়ার হোসেন আখন্দ, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মীর শহীদুল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন করে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বানারীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার নির্যাতিতদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা ও লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করেন। সূত্রে আরো জানা গেছে, কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্ব-স্ব থানাকে অভিযোগের তদন্ত ও মামলা রুজু করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। মামলা রুজু করাতো হয়নি বরং থানা পুলিশ তদন্তে গিয়ে ২০০১ সালের হামলাকারীদের কাছেই হামলার কাহিনী শুনতে চাওয়ায় ওইসময় এলাকায় ফের উত্তেজনা দেখা দেয়। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পর এক প্রকার ধামাচাপা পড়ে যায় তদন্ত কমিশনের সকল কর্মকান্ড।
২০০১ সালের মিডিয়ার বহুল আলোচিত ও নির্যাতিত আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের কমলা রানী রায় আক্ষেপ করে বলেন, নামেমাত্র তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিলো। নির্যাতিতরা বিচারতো পায়নি ববং বিচার চেয়ে কমিশনের কাছে অভিযোগ দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে পুর্ণরায় শত্র“ হয়েছে। ফলে আগামী দশম সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে পূর্ণরায় বিএনপি-জামায়াতের হামলার আশংকায় ইতোমধ্যে অনেক সংখ্যালঘুরাই দেশ ছেড়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ২০০১ সালের নির্যাতিত আগৈলঝাড়ার শেফালী রানী সরকার, পাশবিক নির্যাতনের শিকার রেনুকা অধিকারী ওরফে কালা বউ, বিল্বগ্রামের কালিয়া দমন গুহ, খাঞ্জাপুরের প্রণব রঞ্জন বাবু দত্ত, গেরাকুলের হেলাল মিয়া, হরিসেনার নিহত ছাত্রলীগ নেতা সফিকুল ইসলাম বুলেটের পিতা রহমত উল্লাহ খলিফাসহ অসংখ্য ব্যক্তিরা জানান, ২০০১ সালের নির্মম নির্যাতন, হত্যা, হামলা, মামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় ওইসময় তারাসহ অন্য নির্যাতিতরা জোট ক্যাডারদের বিচারের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ব্যর্থ হয়েছেন। অতঃপর যাদের জন্য এ নির্যাতন হতে হয়েছিলো সেই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিরাই তাদের অবমূল্যায়ন করেছেন। দলের স্থানীয় র্শীর্ষ নেতারা নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের দলের মধ্যেই কোনঠাসা করে রেখেছেন।
দলীয় সূত্র মতে, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ৫০টি, রামানন্দেরআঁক গ্রামের ২৫টি, বাহাদুরপুর গ্রামের ৩০টি, বাকাল গ্রামের ২৫টি, পতিহার গ্রামের ৩০টি, গেরাকুল গ্রামের বিএনপি নেতা ও খুলনার খুনী এরশাদ সিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গোলাম মোর্শেদ পান্না ও তার বাহিনীর হামলায় ২০টিসহ অসংখ্য পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। এছাড়াও জোট ক্যাডারদের হিংস্র থাবা থেকে এসব এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ নৌকার সমর্থক পরিবারের মেয়েদের রক্ষা করতে গোপনে অধিকাংশ মেয়েদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। যারা ভারতে যেতে পারেনি তাদের রাতের আঁধারে কলার ভেলা বানিয়ে পুকুরের মধ্যে রাখা হতো। ওই সময় গৌরনদীর বিভিন্ন গ্রামের দু’শতাধিক পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপন করেছিলো। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হামলার শিকার হয়ে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, কালকিনি, উজিরপুর, বানারীপাড়া, বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলার আ’লীগের হাজার-হাজার নির্যাতিত নেতা-কর্মীরা আগৈলঝাড়া উপজেলার পার্শ্ববর্তী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ার রামশীল গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোলা জেলার লালমোহন থানার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদা প্রসাদ গ্রামসহ ভেন্ডারবাড়িতে এক সময় সকাল হলেই শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, ঘন্টার ধ্বনি আর পূজা পার্বনে মুখরিত হয়ে উঠতো, এখন ওইখানে শুধুই শুনশান নিরবতা। হাসি নেই কারো মুখে। কি এক অজানা আতংকের ছায়া সকলের চোখমুখে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারো বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের নির্মম নির্যাতনের আশংকায় ইতোমধ্যে বহু সংখ্যালঘু এলাকা ছেড়ে ভারত কিংবা অন্যত্র চলে গেছেন। গ্রামের একাধিক ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ের নির্মম সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ১৯৭১ সালের পাক সেনাদেরও হার মানিয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে ওই গ্রামের প্রতিটি সংখ্যালঘু পরিবারের দিন কাটছে আতংকের মাঝে। নির্বাচন পরবর্তী সেইদিনের সহিংসতার কথা মনে হলেও এখনও শিউরে ওঠেন ওই গ্রামের সংখ্যালঘুরা। সূত্রমতে, ভোলা জেলায় ২০০১ সালে হিন্দু ধর্মালম্বী ছিলো ৭২ হাজার ২৭৫ জন। সর্বশেষ আদম শুমারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জনে। আর লালমোহন উপজেলার লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চারটি গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারছিলো ৪ হাজার ৬’শ। স্থানীয় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের দেয়া তথ্যানুসারে, বর্তমানে ওই ইউনিয়নে হিন্দু ভোটারের সংখ্যা মাত্র ৬’শ জন। ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের হরিমোহন বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনার পর থেকে গ্রামগুলোর অধিকাংশ হিন্দু পরিবার এলাকা ছেড়ে ভারতসহ বিভিন্নস্থানে চলে গেছে। যারাওবা দেশে রয়েছে, তারাও মহাআতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা জানান, গত এক মাসের ব্যবধানে মন্টু লাল, লক্ষন চন্দ্র দাস, খোকন দাস, হিমাংশু দাস, নিতাই দেবনাথ, বাসুদেব চন্দ্র দাস, অর্জুন, জয়দেব, স্বপন, করুনা কান্তি দাসসহ এলাকার কমপক্ষে শতাধিক ব্যক্তি এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এছাড়াও নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতার আশংকায় গত দু’মাসের মধ্যে লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ৩’শ সংখ্যালঘু ভারতে চলে গেছেন। সূত্রমতে, ওই গ্রামে ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু পরিবারদের বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর, লুটপাট ও নারীদের ওপর গণধর্ষনসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা ২০০১ সালের সেই দৃশ্যের কথা মনে করে আজো আঁতকে ওঠেন। লর্ডহার্ডিঞ্জ বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী জগন্নাথ দাস বলেন, আগে এ বাজারে বহু সংখ্যালঘু ব্যবসায়ী ব্যবসা করতেন। এখন তাদের কেউ নেই বললেই চলে। তিনি আরো বলেন, লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের গত বছর দূর্গাপূজা হয়েছিল ৮টি মন্ডপে। কিন্তু এবছর তিনটি কমে পূজা হবে মাত্র ৫টি মন্ডপে।
লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাসেম মীর বলেন, ২০০১ সালে জোট সরকারের সময়ে শুধু সংখ্যালঘুরাই নয়, আমি নিজেও ওই সময়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ সাত বছর পর আবার এলাকায় ফিরি। এ ব্যাপারে ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর নিরাপত্তা দিতে ইতোমধ্যে আমরা সব ধরনের ব্যাবস্থা গ্রহন করেছি। বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ বলেন, জেলার সকল উপজেলার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে স্ব স্ব থানা পুলিশের বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও আমি প্রায় প্রতিটি উপজেলার হিন্দু নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছি।