ফাঁসছেন খালেদা তারেক

10/02/2014 3:58 pmViews: 16

 

khaleda ziaবহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় এবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রায়ের কপি প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনার পর ঘটনার সঙ্গে এ দুজনের সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টি এক রকম নিশ্চিত হওয়া গেছে।

তদন্ত করে তাদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর পরই দায়ের করা হবে এ সংক্রান্ত আরেকটি মামলা। সরকারের নীতি-নির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র আরও জানায়, অস্ত্র চোরাচালান ও আটক সংক্রান্ত পৃথক দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হলেও ঘটনার সঙ্গে খালেদা ও তারেকের বিরুদ্ধে নতুন করে আরেকটি মামলা করার ব্যাপারে কোনো আইনগত জটিলতা থাকবে না। এমনকি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও প্রয়োজন হবে না।

আদালতের পর্যবেক্ষণে যাদের নাম এসেছে, তদন্তে তাদের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার সত্যতা মিললেই নতুন মামলা করা যাবে। পুরো বিষয়টি সরকারের আইন বিষয়ক নীতিনির্ধারকরা গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এই পর্যবেক্ষণের পর পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা খুব শীঘ্রই শুরু করবে তাদের তদন্ত কাজ।

২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল রাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটকের ঘটনা ঘটে। গত ৩০ জানুয়ারি অস্ত্র চরাচালান ও আটকের মামলার রায় ঘোষণা করে চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১। ওই রায়ে অস্ত্র চরাচালান মামলায় সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

এছাড়া অস্ত্র আটকের মামলায় এই ১৪ জনকেই যাবজ্জীবন ও সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর প্রত্যেক আসামিকে ‘হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে’ জরিমানা করা হয় পাঁচ লাখ টাকা।
এছাড়া অস্ত্রের চালান আটক হওয়ার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘নীরবতা ও নির্লিপ্ততার’ কথাও উঠে এসেছে রায়ের পর্যবেক্ষণে।

এতে বলা হয়েছে, ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের কথা শুনেও নীরব ছিলেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক সাদিক হাসান রুমী তাকে অস্ত্র আটকের তথ্য জানিয়েছিলেন।

এতবড় একটি ঘটনার বিষয়ে অবহিত হয়ে কোনোরূপ কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে তত্কালীন সরকার প্রধানের নীরব ভূমিকা পালনও রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হয়। বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে এ মামলায় হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

সরকারের একজন নীতি-নির্ধারক জানান, ঘটনার সময় গুলশানের হাওয়া ভবন ছিল খালেদা জিয়ার বড় ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কার্যালয়?

অভিযোগ আছে, এই হওয়া ভবন থেকে তখন সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের দিক-নির্দেশনা দেয়া হতো। ভবনটি ‘প্যারালাল গভর্নমেন্ট’ হিসেবে সবার কাছে ছিল ব্যাপক পরিচিতি। যেহেতু হওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার কথা রায়ের পর্যবেক্ষণে চলে এসেছে, তাই ওই সময় ভবনের কর্ণধার তারেক জিয়াকে আসামি করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক শুক্রবার বর্তমানকে বলেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের সার্টিফাইড কপি দুই দিন আগে আমার হাতে এসেছে। আদালতের পর্যবেক্ষণের আলোকে রায়ের কপি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। রায়ের কপি পর্যালোচনার পর এবং তদন্তে যদি বেরিয়ে আসে তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, সে ক্ষেত্রে নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
খালেদা জিয়া ও তারেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার বিষয়ে ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত মঙ্গলবার রাতে জাতীয় সংসদে তিনি বলেছেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার বিচারের সময় সাক্ষীদের সাক্ষ্যে যেহেতু বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি চলে এসেছে, তাই এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিতে একটি তদন্ত হওয়া দরকার।’ এর পিছনে কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে কি না, কোথা থেকে টাকা এসেছে এবং এর সঙ্গে অন্য কারা জড়িত, সেটাও তদন্তের আওতায় আনার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী?

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচার কার্যক্রম ও গোটা প্রক্রিয়াটি চালানো হয়েছে। পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। গোটা বিশ্বের কাছে যখন সরকারের বৈধতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে, তখন জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে বৈধতাহীন সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ওই অস্ত্র মামলার বিষয়ে দেশের কোটি মানুষের প্রিয় নেত্রী সম্পর্কে অসত্য ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা তার এহেন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’

রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি সরকারের সময়ে দশ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়েছে। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ও নেত্রী এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে, তদন্ত করে বিচার কার্যক্রমও আমাদের সরকার শুরু করেছে। আর এখন খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতেই প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে তার ভূমিকা দেশের মানুষের জানা আছে। মিথ্যাচার করে এ নিয়ে বিভ্রান্ত করা যাবে না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা কোনোভাবেই তত্কালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অজান্তে হয়নি? তবে তারা কি কারণে এবং কোন নীতির ভিত্তিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাকে এই অস্ত্র পাচারে সহযোগিতার চেষ্টা করেছিলেন, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু তাদের এই নীতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং ক্ষতিকর? এতে রাষ্ট্র বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান আরও জানান, যেভাবে সেই সময়ের গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ হয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক? তাদের রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে? সে সময়কার দুজন মন্ত্রী সরাসরি এ ঘটনায় জড়িত বলে প্রমাণও হয়েছে? যা প্রমাণ করে এইসব অস্ত্রের চোরাচালানে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত তত্কালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নেয়া হয়েছে?

সুপ্রিমকোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বৃহস্পতিবার বর্তমানকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলে থাকেন তাহলে অন্য কথা। আর যদি তিনি ‘মিন’ (যথার্থই) করে বলে থাকেন তাহলে তার এই বক্তব্যে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া ও রায় নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করছি। অর্থাত্ রায় সঠিক হয়নি এবং পুনঃবিচার দরকার। এক্ষেত্রে রায় বাতিল ও পুনঃতদন্তের জন্য সরকারকে আপিল করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আদালতের পর্যবেক্ষণে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিষয়টি তদন্ত করা যাবে। তদন্তের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে সরকার। এ ব্যাপারে আপিলের প্রয়োজন হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারের যেসব নীতি-নির্ধারক মামলার রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, তাদের একজন বর্তমানকে বলেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র অবৈধভাবে পাচারের ঘটনাটি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) সাদেক হাসান রুমী নিজে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন।

তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, যিনি এই মামলার অন্যতম অপরাধী, তার সাক্ষ্য থেকেও জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অস্ত্র ধরা পড়ার ঘটনাটি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।

এই নীতি-নির্ধারক আরও জানান, খালেদা জিয়া ঘটনার কথা জেনেছিলেন, অথচ এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। প্রমাণিত হয়েছে যে তার সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। চট্টগ্রামের স্থানীয় পুলিশ এ নিয়ে থানায় মামলা করেছিল, কিন্তু পরে মামলাটি গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তরিত হয়। তারা এ নিয়ে কার্যত কিছুই করেনি।

খালেদার আমলে এ বিষয়ে মামলা করা হয় এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এ কথা ঠিক। কিন্তু সেই কমিটির কোনো প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি, কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। উল্টো পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

Leave a Reply