পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা, তাপস, সেলিম সরাসরি জড়িত: নিহতদের স্বজন
বিডিআর বিদ্রোহের নামে ২০০৯ সালে পিলখানায় যেই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তার সঙ্গে শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন নিহত সেনা অফিসারদের স্বজনরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের স্কাইলাইন রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা বলেন তারা।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দেশপ্রেমিক অনেক সেনা অফিসার বিচার চাইতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ জেলে গেছেন। দরবারের শত শত অফিসারের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। তাই আমরা দাবি করছি, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত সেনা অফিসারদের পরিবারকে যেন যথাযথ সম্মান ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। যেসব নির্দোষ, দেশপ্রেমিক বিডিআর সৈনিক জেল খাটছেন, সুষ্ঠু তদন্তে যেন তাদের মুক্তি দেয়া হয়। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্য করে রাকিন আহমেদ বলেন, আপনারা সাংবাদিকরাও কম নির্যাতনের শিকার হননি। অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না।
এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন- ওনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার বাবা-মা’কে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে বাবা-মা’র মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই- যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অন্য একটা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাজধানীতে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করে। ওই দিনটিকে আমরা শহীদ সেনাদিবস দাবি করছি। রাকিন আহমেদ বলেন, গত ১৫ বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ট্রায়াল বা তদন্তকে আমরা মানি না। কারণ প্রধান যে হত্যাকারী, নির্দেশদাতা তিনি তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কী তার নিজের বিচার করবে? মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়েছে, কেমন করে তদন্ত, ট্রায়াল প্রভাবিত করলো, ডাল-ভাতের কথা বলল। নীরবতায় সহ্য করতে হয়েছে। সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী এগিয়ে যায়। তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না করে এগিয়ে এসেছেন। জনগণকে অনুরোধ করবো, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করুন।
সংবাদ সম্মেলনে নিহত লে. কর্নেল এনায়েতুল হকের মেয়ে নাবিলা বলেন, এটা আন্তর্জাতিক চক্রের কাজ। আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বারাই কাজটি করা হয়েছে। আপনারা বের করবেন আসল কারণ। এটা বিদ্রোহ নয়, এটা হত্যাকাণ্ড, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। আমার বাবা মারা যাননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কিছু অপপ্রচারের জন্য আমরা হেনস্তা হয়েছি। এতদিন ভয়ে কথা বলিনি, আজ নির্ভয়ে কথা বলছি। ১৫ বছর ধরে আমাদের একটাই দাবি, বিচার চাই। একটা স্বচ্ছ বিচার হোক। আমরা এ বিষয়ে আর লুকোচুরি চাই না। চাপ দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। বাধার মধ্যে ১৬ বছর পার করেছি। নিহত মেজর কাজী মোসাদ্দেক হোসেনের মেয়ে নাজিয়া বলেন, আমাদের কষ্টের কথা যদি বলি, একই পরিস্থিতিতে এখনও যাচ্ছি। কষ্ট দূর হয়ে যায়নি। এর পেছনে অনেক ঘটনা ছিল। আমরা তো আমাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেছি। মানুষ জানুক এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে। কেন এত বছর পরও আমাদের মুভমেন্টে বাধা হয়। নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমানের স্ত্রী লবী রহমান বলেন, হয়তো বলবেন এতদিন পর কেন আমরা এখানে। অনেক কিছুই তো পেয়েছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে আমরা কিন্তু শুধু বিচারই চেয়েছি। প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন করা হয়, কি কি পেয়েছি। ইচ্ছা হয় সব ফেরত দেই, আমার স্বামী শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীকে ফিরিয়ে দেন। এটা সিনেমা বা নাটকের প্রমোশন না, এটা খুবই সেনসিটিভ।
পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের ছেলে এডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, এই ঘটনায় দুটো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। বাহিনীর পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমরা খুব করে চাইবো অন্তত তার তদন্ত কমিটির রিপোর্টটা পাবো। কারণ আমরা খুব কাটছাঁট অংশ গণমাধ্যমে জেনেছি। আমরা পুরোটাই দেখতে চাই। তাতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো। আর উচ্চ আদালত যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, সেগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে পর্দার আড়ালে যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা বেরিয়ে আসবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা চার্জ করতে পারবো। তিনি বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি তো কাউকে সরাসরি দায়ী করতে পারি না। আমরা তো অনেক নাম শুনি। আপনারাও শোনেন। কিন্তু সেই নামগুলো আমরা তখনই বলতে পারবো যদি তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। এমনি এমনি নাম বলে দেওয়া যায় না। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করারও পরামর্শ দেন তিনি। এ সময় পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত ৫৭ সেনা অফিসার ও ১৭ সাধারণ নাগরিকের পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন এডভোকেট সাকিব রহমান।
দাবিগুলো হলো- ১. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে আগে যে সমস্ত তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। ২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিনজন জজ যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, অবিলম্বে সেই তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে। ৩. অফিসিয়াল গেজেট করে ২৫শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনাদিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গেজেটে শাহাদাতবরণকারী সকলকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। ৪. ২৫শে ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা ও শোক দিবসকে ঘিরে গোটা দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। ৫. পিলখানা ট্র্যাজেডিকে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে, কি ছিল এই শহীদদের ত্যাগ। ৬. যে সকল সেনা কর্মকর্তা এ ঘটনাকে ঘিরে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ কম্পেন্সেশন প্রদান করতে হবে। ৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর সদস্যকে যেন কোনোভাবেই সাজা না দেয়া হয়।