পথে পথে দুর্ভোগ, তবু নাড়ির টানে ঘরে ফিরতেই হবে
রাস্তায় নানা দুর্ভোগ আর যন্ত্রণা পোহাতে পোহাতে ঘরমুখো মানুষকে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতেই হচ্ছে। একদিকে ছেলেমেয়ে, অন্যদিকে লাগেজ নিয়ে ছোটাছুটি। বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশনের একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরছেন সবাই। মানুষের এ ভোগান্তি নিজের চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই ঘরমুখো মানুষ কতটা কষ্ট সহ্য করে প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছে। তবুও বাড়ি যেতে হবে, কারণ একদিন পরই ঈদ-উল-আযহা। সঙ্গে কোরবানি আর প্রিয়জনের সাক্ষাত। এটা যেন সোনার হরিণ। তাই তো মানুষের এই ছুটে চলা। নাড়ির টানে তাদের যে কোন উপায়ে বাড়ি যেতে হবে। তাদের জন্য স্বজনদেরও অপেক্ষার কোন শেষ নেই। তারাও কাছে পাওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। কখন আসবেন পরিবারের চাকরিজীবী ভাই, বোন বা আদরের সন্তান। এ অপেক্ষা তাদের আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত করতে হবে।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার সকালে আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষের চলাচল নির্বিঘœ রাখতে গাবতলী এলাকায় যানজট পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি গাবতলী বাস টার্মিনালে উপস্থিত যাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রাপথে দুর্ভোগ হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, জনগণের জন্য সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছি। সফলতা ও ব্যর্থতার বিচারের ভার জনগণের। তিনি এ সময় বাস কাউন্টারগুলোকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করার জন্য অনুরোধ করেন এবং গাবতলী-আরিচা মহাসড়কে যেন কোন যানজট সৃষ্টি না হয় সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। পরিদর্শনের সময় বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বিআরটিসির চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহসহ স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এবারের ঈদে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চের চলাচল অধিকতর নির্বিঘœ করতে কায়েকটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঈদে দেশের উল্লেখযোগ্য নৌরুটে টহল দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএর মোট ৮০টি জাহাজ। এ সব জাহাজে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও রয়েছেন পুলিশ, ব্যাব ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। পথিমধ্যে লঞ্চ থামিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী উত্তোলন, অন্য লঞ্চের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বা পথ নির্দেশিকা না মানায় ডুবোচরে আটকে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে এ সব টহল দল। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া বন্দরসমূহকে কেন্দ্র করে দিবা-রাত্রি পালাক্রমে টহল দিচ্ছে এ সব পর্যবেক্ষণ টিম। ইতোমধ্যে সুফল পাওয়া যাচ্ছে টিমের কার্যক্রমের। বরিশাল থেকে ঢাকা আসার পথে মার্কা না মেনে চলায় গত শনিবার রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে প্রায় দেড় হাজার যাত্রী নিয়ে ভাষাণচরের ডুবোচরে আটকে যায় এমভি কীত্তনখোলা-১ নামক একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যায় বিআইডব্লিউটিএর টহলধারী টাগ জাহাজ ‘অগ্রগতি’। টাগ জাহাজ দিয়ে লঞ্চটি টেনে নামিয়ে মূল চ্যানেলে এনে দেয়া হয়। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা যাওয়ার পথে স্টিয়ারিং বিকল হয়ে বরিশালের উজানে চরবাড়িয়ায় ডুবোচরে আটকে যায় নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস আমানত। নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে এসওএস পাঠানো হয় বিআইডব্লিউটিএর টাগ জাহাজ অগ্রগতিতে। ছুটে যায় অগ্রগতি। টেনে নামানো হয় বিএনএস আমানতকে। ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে দেশের নৌরুটের বিপুলসংখ্যক যাত্রীর ভ্রমণ নির্বিঘেœ এবং সহজ করার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিআইডব্লিউটিএ গৃহীত এ সব পদক্ষেপের কারণে ইদানীং বড় ধরনের কোন নৌদুর্ঘটনা ঘটছে না। বিআইডব্লিউটিএ গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদানের জন্য প্রধান কার্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং সদরঘাট টার্মিনালসহ দেশের সব নদীবন্দরে কন্ট্রোল রুম বসানো হয়েছে। সদরঘাট টার্মিনালে পুলিশ, র্যাব এবং কোস্টগার্ড পৃথক কন্ট্রোল রুম স্থাপন। এ ছাড়া পকেটমার, ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টির কবল থেকে যাত্রীদের রক্ষার্থে সার্বিক নিরাপত্তা এবং বন্দর কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য সদরঘাট টার্মিনালে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে সদরঘাট টার্মিনাল ইজারামুক্ত হওয়ায় এবং ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে সদরঘাট এলাকায় যাত্রীরা কুলির হয়রানি থেকে মুক্তি পেয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীরা নির্বিঘেœ লঞ্চে আরোহণের সুযোগ পাচ্ছে। সদরঘাট টার্মিনালে অতিরিক্ত যাত্রীর ভিড় এড়াতে মূল টার্মিনাল থেকে ওয়াইজঘাট, সোয়ারিঘাট হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত পন্টুন বর্ধিত করে অঞ্চলভিত্তিক লঞ্চ ভিড়িয়ে ১৩টি গ্যাংওয়ের মাধ্যমে যাত্রীদের নির্বিঘেœ লঞ্চে উঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ থেকে সদরঘাট টার্মিনাল পর্যন্ত রাস্তায় একমুখী চলাচলের ব্যবস্থা করা হযেছে। টার্মিনালের তথ্য ও অনুসন্ধান কেন্দ্র হতে মাইকে সর্বক্ষণিকভাবে যাত্রী সচেতনতাসহ নানা পরামর্শ ও নির্দেশনামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। ঈদ ব্যবস্থাপনায় বিএনসিসি, রোভার স্কাউট ও বিআইডব্লিউটিএর ক্যাডেট সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাঁরা নির্ধারিত জ্যাকেট ও ক্যাপ পরে কাজ করছেন, যাতে সহজেই লক্ষণীয় হয়। লঞ্চে সহনীয় পর্যায়ে যাত্রীবোঝাই হলেই বন্দর কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত সমন্বয় কমিটির নির্দেশে ভয়েজ ডিক্লারেশন রেখে লঞ্চ গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে কোন লঞ্চই ওভারলোড হওয়ার সুযোগ থাকছে না। গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটগুলোতে স্পেশাল লঞ্চ সার্ভিস থাকায় মাত্রাতিরিক্ত বোঝাই হওয়ার সুযোগ নেই। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ৫০-৬০টি লঞ্চ সার্ভিস চালু থাকে, সেখানে ঈদ কেন্দ্র করে ১৩৫-১৪০টি করা হয়েছে। নদী বন্দরগুলোর টার্মিনালে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা নিশ্চিতসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যাত্রীবাহী লঞ্চের নির্বিঘœ চলাচলের জন্য বালিবাহী ও কার্গো জাহাজের রাত্রীকালীন চলাচল এবং নৌরুটে মাছধরার জাল ফেলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দুর্ভোগ যে হচ্ছে না, এমনটিও নয়। আমি দুর্ভোগ ও কষ্টের জন্য সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা থাকার জন্য বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের কাছেও আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। আজ ও আগামীকাল যাত্রীর চাপ থাকবে। পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া সরকারী অনেক কর্মচারী বাড়িতে ঈদ করতে যাবেন। বাড়তি এ চাপ সামলানোর জন্য আমরা অতিরিক্ত ৬০টি বিআরটিসি বাস প্রস্তুত রেখেছি। যখনই মালিক সমিতি গাড়িগুলো চাইবে, টার্মিনালে পৌঁছে যাবে। এ সরকারের আমলে প্রথম চার লেনের কাজ শুরু হয়ে শেষও হয়েছে। নবীনগর-চন্দ্রা পর্যন্ত এ চার লেনটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করবেন।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতাই দুর্ঘটনার কারণ। শনিবার মা-মেয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এতে আমি মর্মাহত। যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে এ সব ঘটনায় অপরাধী মনে হয়। আমার মনে হয়, মন্ত্রী হিসেবে আমি এ দায় এড়াতে পারছি না।
সড়কের ভোগান্তি কমানো প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমাদের লোকজন রাস্তায় রয়েছেন। আমি সবার সঙ্গে আছি। আমাদের মনিটরিং টিম রয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, থানা, উপজেলা পুলিশ, সড়ক ও জনপদ, হাইওয়ে, র্যাব, স্থানীয় সরকার ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এক হয়ে কাজ করছে।
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, দেশে লোকজন কত গুজব, কত গুঞ্জন, কত জল্পনা উৎপন্ন করে। আমার মনে হয়, অকাশে যে মেঘ আছে তা কেটে যাবে। এক সময় সূর্য আলো দেখাবে। রাজনৈতিক যে অবস্থা চলছে তাতে উদ্বেগের কোন কারণ নেই। আপনারা কারও গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না।
রবিবার বাস, লঞ্চ ও নৌরুটে মানুষের স্রোত সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ নানা পক্ষক্ষেপ নিয়ে থামাতে পারেনি। তারা যে কোন উপায়ে বাড়ি যেতে চান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে ও ট্রেনের ছাদে আসন নেয়। একইভাবে বাসের ছাদেও মানুষের কমতি নেই। প্রিয়জনদের টানে তাদের ঘরে ফিরতেই হবে, এতে জীবন থাক আর না থাক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলা শুরু হয়েছে গত কয়েক দিন ধরেই। সামনে আরও দুই দিন এমন ঝুঁকি নিয়ে ঘরমুখো মানুষ ঘরে ফিরবে।
ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। রবিবার বিকেলে ঈদের বিশেষ ট্রেন পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেন। রেলের ইঞ্জিন সংযোজন, মেরামত ও পথে দেরি হওয়াতে সিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটছে। আমরা ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া ও স্টেশনে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। দিনাজপুরগামী অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ২টা ২০ মিনিটে প্লাটফর্ম ছাড়ার কথা থাকলেও ৩টা ৩২ মিনিটে ছেড়ে যায়। এভাবে সকাল থেকে ১২-১৪টি ট্রেন পৌনে এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ার কথা অস্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, সামান্য দেরিকে সিডিউল বিপর্যয় বলা যাবে না।
মন্ত্রী বলেন, ঈদ ও পুজো পৃথক সময় হওয়াতে বাড়ি ফেরা যাত্রীর সংখ্যা কম। ঈদের দুই দিন পর থেকে সাত দিন পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রীরা যাতে ফিরে আসতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। আসার সময় সিডিউল বিপর্যয় হবে না বলেও আশ্বাস দেন মন্ত্রী।