নৃশংস ও বর্বর এক হত্যাকাণ্ড

21/05/2014 4:22 pmViews: 9

 

 

নৃশংস ও বর্বর এক হত্যাকাণ্ড

 

একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে ফেনীর জনাকীর্ণ বিলাসী সিনেমা হলের সামনে একদল দুষ্কৃতিকারী ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান,উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে মঙ্গলবার নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। দুর্বৃত্তরা তার গাড়ি থামিয়ে প্রথমে গুলি চালায় এবং পরক্ষণেই এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপরও দুর্বৃত্তরা ক্ষান্ত থাকেনি। তারা একরামুলকে গাড়ির ভিতরে রেখেই পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে কয়লায় পরিণত করে নিশ্চিন্তে চলে যায়। এ সময় একই গাড়িতে থাকা এক সাংবাদিকসহ চারজন আহত হয়েছেন।

 

আহতরা হলেন ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন (৬০), একরামুলের ব্যবসায়িক সহযোগী হোসেন (৩৮), স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক ফেনী সমাচার-এর সম্পাদক ফরহাদ (৩২) ও গাড়িচালক মামুন (৩০)। তাদের ফেনী ও ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

 

সফল সংগঠক, জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফেনীর সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নজিরবিহীন বর্বরতার খবর ছড়িয়ে পড়তেই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সাধারণ মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অলিগলি, মহল্লার বাসাবাড়ি থেকেও নারী-পুরুষরা বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

 

হত্যাকাণ্ডের জেরে বিকাল ৪টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারের বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেয়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের খণ্ড খণ্ড মিছিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ফেনী জেলা শহরের সর্বত্র। একরামুল হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তার নিজ উপজেলা ফুলগাজীর মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সেখানে তার সমর্থকরা যানবাহন ও দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করেন। পরে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের ফুলগাজী অংশে গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করেন। মহাসড়কের মহীপাল হাইওয়ের পরিদর্শক এ এস এম জাহাঙ্গীর আলম জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান নিহতের প্রতিবাদে বেলা ৩টার দিকে দলীয় নেতা-কর্মীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে বলে পুলিশ সুপার অফিস সূত্র নিশ্চিত করেছে। ফেনী জেলা শহরে পুলিশ, র‍্যাবের পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে জেলা আওয়ামী লীগ শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে হত্যার নিন্দা জানিয়ে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে।

 

যেভাবে হত্যা করা হয়
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে ফেনী শহরের একাডেমি সড়কের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে খুন হন উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক। তিনি ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ফেনী ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একরামুল হক ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের বন্দুয়া দৌলতপুর গ্রামের মাষ্টার নুরুল হকের ছেলে।

 

একরাম চেয়ারম্যানের গাড়ীতে থাকা স্থানীয় সাপ্তাহিকটির সম্পাদক আহত মহিবুল্লাহ ফরহাদ জানান, তারা চেয়ারম্যান একরামুল হকসহ ৫ জন ফেনী ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে ফুলগাজী যাচ্ছিলেন।

 

বিলাসী সিনেমা হলের কাছাকাছি পৌঁছার পর তাদের গাড়ীর সামনে একটি টমটম দিয়ে পথ রোধ করা হয়। সন্ত্রাসীরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চেয়ারম্যানকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। এ সময় গুলি তার বুকে লাগে। তার চালকসহ চার জন আহত অবস্থায় কোন রকমে গাড়ি থেকে বের হতে পারলেও চেয়ারম্যান বের হতে পারেননি।

 

এ অবস্থায় সন্ত্রাসীরা গাড়িতে আগুন দেয়। এতে গাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায় এবং তিনি নিজেও পুড়ে মারা যান। এ ঘটনা জানা জানি হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ হাজারো মানুষ হাসপাতাল ও ঘটনাস্থল একাডেমি এলাকায় ভীড় জমায়। একাডেমি সড়কের সব দোকানপাঠ বন্ধ হয়ে যায়।

 

আহতরা কেমন আছেন
এ সময় আহত চার জনের মধ্যে গাড়ি চালক আবদুল্লাহ আল মামুন (৩০) ও আবুল হোসেনকে (৪৫) ফেনী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

 

অপর আহত ফুলগাজী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মহি উদ্দিন সামু (৬০) ও মহিবুল্লাহ ফরহাদকে (৩২) পুলিশ হেফাজতে রেখে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

 

খবর পেয়ে ফেনী-১ আসনের (ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম) সাংসদ শিরিন আক্তার ছুটে যান সদর হাসপাতালে। বিকেল সোয়া ৩টায় ফেনীর স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলা উদ্দিন চৌধুরী নাসিম ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে ফেনী পৌঁছেন।

 

বিকেলে শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও ট্রাংক রোডে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে জেলা আওয়ামী লীগ আবদুর রহমানে সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ রহিম উল্ল্যাহ, যুবলীগ নেতা শুসেন চন্দ্র শীল প্রমুখ।

 

বক্তারা অভিলম্বে এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

 

রাত পর্যন্ত ক্লু উদযাটন হয়নি
একরাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন ক্লু উদযাটন হয়নি। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, দলীয় কোন্দলের বলি হয়েছেন একরাম। ফেনীতে গডফাদার ও সন্ত্রাসের হাত বদল হয়েছে সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। তাই খুন, অপহরণ, গুম, ছিনতাই নিত্য ঘটনায় পরিনত হয়েছে।

 

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, “নির্বাচনী বিরোধ এবং তার (একরাম) ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে এধরনের বিভৎস ঘটনা ঘটানো হতে পারে।”

 

জেলা যুবলীগ নেতারা ঘটনার জন্য উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন মিনার এবং বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছেন। হত্যার ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি, পুলিশ কাউকে আটক করেনি।

 

হাসপাতালে নেতা-কর্মীদের ভিড় স্বজনদের আহাজারী
একরামের লাশ এক নজর দেখার জন্য ফেনী সদর হাসপাতালে নেতা-কর্মীরা। হাসপাতালে ছুটে এসেছেন সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবসহ সাধারণ। স্বজনদের আহাজারীর শেষ নেই। সাধারণ মানুষের চাপ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের সবগুলো গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। তারপরও মানুষের চাপ সামলাতে কষ্ট হয়।

 

লাশ ডিএনএ টেস্টের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে
ডিএনএ টেস্ট করার জন্য চেয়ারম্যান একরামের লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ৩টার দিকে ফেনী মডেল থানার এসআই মোবারক হোসেনের নের্তৃত্বে পুলিশের একটি দল ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়।

 

ভুতুড়ে নগরী ফেনী
হঠাৎ ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে ফেনী। কর্মব্যস্ত চিরচেনা নগরীতে নেমে এসেছে নিরবতা। শহরের রাস্তাঘাটে নেই মানুষজন, নেই গাড়ী, দোকানপাটও বন্ধ। এ যেন এক অচেনা শহর। সর্বত্র আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। শহরের র‍্যাব-পুলিশের সাথে টহলে নেমেছে বিজিবি।

 

৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
হত্যার ঘটনার পর শহররের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করেছে জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার দুপুর একটা থেকে বিজিবি সদস্যরা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টহল দিচ্ছে। ফেনী জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির খোন্দকার বিজিবি মোতায়েনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “শহরের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখেতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।”

 

একরামুল হত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা ও ক্ষোভ
একরামুল হককে নির্মমভাবে গাড়িসহ পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একরামুল হক অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন তরুণ নেতা ছিলেন। ফুলগাজীকে একটি আধুনিক উপজেলায় পরিণত করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।”

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা দেশের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী, যারা হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করতে চায় সেই দেশবিরোধী অশুভ শক্তিই একরামুল হককে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে।”

 

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলগাজীবাসী এবং সমগ্র দেশবাসীকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।”

 

তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। শোকসন্তপ্ত ফুলগাজীবাসী ও মরহুমের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে তার প্রতিশ্রুতি পূনর্ব্যক্ত করেন।

 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ
ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামকে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে ফেনী শহরের মহিপাল অংশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে স্থানীয় যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। মঙ্গলবার দুপুরে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ওই মহাসড়কে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় কিছু গাড়ি ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা।

 

ফেনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, বিকেল ৪টায় বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে।

 

যুবলীগের বিক্ষোভ
একরাম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে ফেনী শহরে তাৎক্ষনিক বিক্ষোভ মিছিল করেছে যুবলীগ। জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক দিদারুল কবির রতন ও ফেনী পৌর আহ্বায়ক মামুনুর রশিদ মিলন মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তারা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেন।

 

ফুলগাজীতে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর
একরামকে গুলি করে এবং পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে ব্যাপক গাড়ী ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগকর্মীরা। বেলা ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পর থেকে এলাকায় উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে।

 

চেয়ারম্যান একরামকে ফেনী শহরে গুলি ও পুডিয়ে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে পেটে পড়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় উত্তপ্ত ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা ফুলগাজীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গাড়ী ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

 

ফুলগাজী থানার ওসি আহাম্মদ নাসির উদ্দিন মোহাম্মাদ জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পরিমান পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

 

ফেনীর পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, “সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি, কেউ আটক হয়নি।”

Leave a Reply