নির্বাচনে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে প্রেসিডেন্ট এরদোগান
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমশই একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চায়।দেশটিতে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর এরদোগানের অবস্থা এখন অনেকটাই নাজুক।আসছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যতো ভোট পড়বে, কোনো প্রার্থী যদি তার ৫০ শতাংশের বেশি পান, তাহলে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। এরকম না হলে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে।
যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে এরদোগান
তুরস্কের ভোটাররা গত কয়েক বছর ধরেই বিভক্ত। কিন্তু ৬৯ বছর বয়সী এরদোগানএবার যতোটা চাপের মুখে পড়েছেন, এর আগে এরকম কখনো হয়নি।জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী জোটের প্রার্থী তার চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।রজব তাইয়েব এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে এ কে পার্টি ২০০২ সালের নভেম্বর মাস থেকে ক্ষমতায়। এবং এরদোগান তুরস্ক শাসন করে আসছেন ২০০৩ সাল থেকে।এবারের নির্বাচনে প্রায় ৬০ লাখ নতুন ভোটার ভোট দেবেন যারা এরদোগান ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেখেননি।এরদোগান শুরুতে ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন এবং ২০১৬ সালে ব্যর্থ এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাটকীয়ভাবে তিনি তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।এখন তিনি বিশাল একটি প্রাসাদ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দেশটির বেশিরভাগ মিডিয়াই তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে।প্রচুর সংখ্যক তুর্কী নাগরিক দেশটিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির জন্য এরদোগানকে দায়ী করেন। কারণ তিনি ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়াতে রাজি হননি।বর্তমানে তুরস্কে সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই হার আসলে ১০০ শতাংশেরও বেশি।
তুরস্কে ৬ই ফেব্রুয়ারির এক জোড়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে এরদোগানও তার নেতৃত্বাধীন শাসক দলের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে সরকার উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে।তুর্কী সরকারের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ উঠেছে যে নির্মাণ খাতে বড়ো ধরনের অনিয়মের কারণেই ভূমিকম্পে এতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।ভূমিকম্পে তুরস্কের ১১টি প্রদেশের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
এরদোগানের প্রতি প্রচুর সমর্থন থাকার কারণে এসব প্রদেশের কয়েকটিকে তার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে দেখা হতো।ধারণা করা হচ্ছে এসব প্রদেশের ওপরেই এরদোগানের জয় পরাজয় নির্ভর করছে।তার রাজনৈতিক দল এ কে পার্টি ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তিনি তুরস্কের উগ্র-জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপির সাথে জোট গঠন করেছেন।
ছয়টি বিরোধী দল- একজন প্রার্থী
৭৪ বছর বয়সী কেমাল কিলিচদারুগলুকে একজন ‘সজ্জন ও পণ্ডিত’ ব্যক্তি বিবেচনা করেন অনেকে। প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপির প্রধান তিনি।এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সিএইচপি পরাজিত হয়েছে।তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন রকমের হতে পারে। কারণ এরদোগানের বিরুদ্ধে তিনি লড়ছেন বিরোধী জোটের একক প্রার্থী হিসেবে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ঠেকাতে ছয়টি বিরোধী রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে এই জোট গঠন করেছে।এই জোটে রয়েছে কিলিচদারুগলুর নিজের মধ্য-বামপন্থী দল সিএইচপি, জায়তাবাদী গুড পার্টিসহ আরো চারটি ছোট ছোট দল যাদের মধ্যে এরদোগানের সাবেক দুজন মিত্রও রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে একজন ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
এটা উল্লেখ করার মতো যে বিরোধী জোটের প্রার্থী কিলিচদারুগলুর প্রতি তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কুর্দীপন্থী এইচডিপির ব্যাপক সমর্থন রয়েছে।
এই দলের একজন নেতা এবারের নির্বাচনকে “তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন” বলে উল্লেখ করেছেন।এইচডিপির সাথে কুর্দী মিলিট্যান্টদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে- এমন অভিযোগে দলটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা থাকার কারণে দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, কিন্তু এই দলের নেতারা অন্য একটি দল গ্রিন লেফট-এর ব্যানারে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দলটি কোনো প্রার্থী দেয়নি।
কেমাল কিলিচদারুগলুকে এরদোগানের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোয় সবাই যে খুশি তা নয়। কারণ অনেকেই মনে করেন আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের মেয়র তার চেয়েও শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারতেন।এই দুজন মেয়রই কিলিচদারুগলুর রাজনৈতিক দল সিএইচপির নেতা। ২০১৯ সালে তারা তুরস্কের বৃহত্তম এই দুটো শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।১৯৯৪ সালের পর এই দুটো শহরে এই প্রথম সিএইচপি দল জয়লাভ করে।
কিলিচদারুগলু একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। তিনি তুরস্কের আলেভি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য।তিনি ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে ২৪ দিন ধরে চলা এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনকে দেখা হয় গত কয়েক বছরের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হিসেবে।এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে বিরোধী জোট ন্যাশন্স এলায়েন্স যা টেবিল অব সিক্স নামেও পরিচিত।এই জোটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য তুরস্ককে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রেসিডেন্ট এরদোগান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তুরস্কে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু করেন।
এই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে তাদেরকে ৬০০ আসনের পার্লামেন্টে ৪০০টি আসনে জয়ী হতে হবে। অথবা এ বিষয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব পাস করতে তাদের ৩৬০ জন এমপির প্রয়োজন হবে।এই জোট নির্বাচিত হলে কিলিচদারুগলু হবেন তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। এবং জোটের বাকি পাঁচটি শরিক দলের নেতারা ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন।
ভোট ভাগাভাগি
নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে দেখা গেছে বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুগলু জনপ্রিয়তার দৌড়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।তুরস্কের জনমত সমীক্ষা যে সবসময় নির্ভরযোগ্য হয় তা নয়।তবে প্রথম রাউন্ডেই কিলিচদারুগলুর সরাসরি জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে যখন তার দলের সাবেক একজন নেতা মুহারেম ইঞ্জে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।৫৮ বছর বয়সী ইঞ্জে ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপি দলের প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু কিলিচদারুগলুর সাথে মতবিরোধের জের ধরে ওই নির্বাচনের দুবছর পর তিনি সিএইচপি ছেড়ে চলে যান।বর্তমানে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী দল হোমল্যান্ড পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ক্রীড়নক হয়ে বিরোধীদের ভোট ভাগাভাগি করার অভিযোগ উঠেছে।সোশাল মিডিয়াতে তার উপস্থিতি বেশ জোরালো। টিকটকে তিনি বেশ সক্রিয় এবং একারণে তরুণ ভোটারদের কাছে তার বেশ জনপ্রিয়তাও রয়েছে।প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরো একজন প্রার্থী রয়েছেন, তবে তার জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি উগ্র-জাতীয়তাবাদী নেতা সিনান ওগান।তিনি সফল হতে না পারলেও, কে তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন তা নির্ধারণে তার পাওয়া ভোট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
ভোটের হিসাব-নিকাশ
তুরস্কে ৬০০ আসনের পার্লামেন্টে স্থান পেতে হলে একটি দলকে, অথবা ওই দলটি যে জোটের সদস্য তাদেরকে অন্তত সাত শতাংশ ভোট পেতে হবে।এ কারণে দেশটিতে জোটের রাজনীতি এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।ছয়টি দল নিয়ে গঠিত বিরোধী জোট নির্বাচনে জয়ী হলে যেসব সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার একটি হচ্ছে এই নিয়ম পরিবর্তন করা। বর্তমানে প্রায় ৩৬ লাখ সিরীয় শরণার্থী তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। সূত্র : বিবিসি