নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ ॥ ২৫ অক্টোবর ॥ উস্কানিতেও সংঘাতের পথে যাচ্ছে না
ওবায়দুল কবির ॥ বিরোধী দলের উস্কানিতে ২৫ অক্টোবর সংঘাতের পথে যাচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংঘাতের পরিবর্তে দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করার উদ্যোগ নিচ্ছে দলটি। ঈদের পরই শুরু হবে দলের আনুষ্ঠানিক নির্বাচন প্রক্রিয়া। রবিবার কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছে। দলীয় কর্মকা-ে আরও সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। একই সঙ্গে ২৫ অক্টোবর বিরোধী দলকে প্রতিরোধ করার জন্য জেলায় জেলায় পাল্টা কর্মসূচী ঘোষণার একটি প্রস্তাবও নাকচ করা হয়েছে বৈঠকে। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একটি প্রস্তাবও বিরক্তির সঙ্গে নাকচ করেছেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে দলীয় সভানেত্রীর প্রস্তাবে একটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারপার্সন থাকবেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজে। কো চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সকল সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্য এ কমিটির সদস্য থাকবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সারাদেশের তিন শ’ আসনের মনোনয়ন চুড়ান্ত করা হবে। ঈদের পরই বসবে মনোনয়ন বোর্ড। সাম্প্রতিক তৃনমূল নেতাদের সঙ্গে সভানেত্রীর বৈঠক এবং মাঠ পর্যায়ের জরিপের ফল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। বৈঠকে প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত জরিপকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা উল্লেখ করে এর কঠোর সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, এসব জরিপ চালানো হয় একটি ‘মাইন্ড সেট’ এর মাধ্যমে। এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মাইন্ড সেট অনুযায়ী জরিপের ফল তাই হয়। এসব জরিপে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ নেই।
বৈঠক সূত্র জানায়, সন্ধ্যা সোয় ৭টায় শুরু হয়ে বৈঠক চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বৈঠকের এজেন্ডা তুলে ধরেন। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী ৩ নবেম্বর জেল হত্যা দিবসের কর্মসূচী গৃহীত হয়। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে বৈঠকের দিক নির্দেশনা দেন। এ সময় তিনি ২৫ অক্টোবরের পরও সংসদ বসার সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু বিরোধী দল আলোচনায় আসেনি তাই সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান মন্ত্রিসভার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী এ মুহূর্তে সকল মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
সাধারণ সম্পাদক তাঁর বক্তব্যে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলেন, এ মুহূর্তে দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয় ২৫ অক্টোবর। এই দিনটি টার্গেট করে বিরোধী দল নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, এ দিনের পর থেকে লাগাতার হরতাল, ঘেরাও কর্মসূচী দেয়া হবে। অসহযোগের ডাক দিয়ে দেশকে অচল করে দেয়া হবে। এ দিন থেকে তারা দেশে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। সরকারের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করতে চায়। এ সময় তারা ‘গনঅভ্যুত্থান’ ধরনের কিছু করারও স্বপ্ন দেখছে। বিরোধী দলের এ ধরনের ঘোষণায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। আমাদের দলের নেতাকর্মীরাও প্রশ্ন করছে, কি হবে দেশে। সরকারইবা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমি মনে করি, সরকার কি করছে এ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আগামী দিনের নীতি নির্ধারণী বিষয় নিয়ে আমাদের খুব একটা কথা বলাও উচিত নয়। এজন্য আমাদের নেত্রী রয়েছেন। তিনি সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা শুধু তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করে যাব। একই সঙ্গে আমি মনে করি বিরোধী দলের এ পরিকল্পনার সঙ্গে কোনভাবে সরকারের জড়ানো ঠিক হবে না। সংঘাতের পরিবর্তে পরিস্থিতিকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে হবে। এটি সম্ভব একমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। দেশের মানুষ সংঘাত চায়না, নির্বাচন চায়। মানুষের এ চাওয়াকে আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি এখন থেকেই দলকে নির্বাচনের দিকে পরিচালিত করার প্রস্তাব করেন।
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য লতিফ সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে স্বাগত জানান। তিনিও এখন থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর পক্ষে মত দেন। সাম্প্রতিক সময় তার দেয়া কিছু বক্তব্য নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের ব্যাখ্যাও দেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দলের জন্য আরও বেশি সময় দেয়া এবং সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমার দলের সাধারন সম্পদকের বিচক্ষণতা রয়েছে। তাৎক্ষনিকভাবে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ক্ষমতা তার আছে। তিনি একজন ভাল সংগঠক। দলের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তিনি তার এ ভাল ইমেজ কাজে লাগালে দল ও দেশের উপকার হবে। তিনি আরও বেশি সক্রিয় হলে আগামী নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এই বক্তব্য সমর্থন করেন।
এর আগে অবশ্য সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যে দ্বিমত প্রকাশ করে দলের প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেন, বিরোধী দল দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইলে আমাদের উচিত প্রতিহত করা। আমাদের সেই সাংগঠনিক শক্তিও রয়েছে। আমরা সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ালে বিরোধী দল কিছুই করতে পারবে না। তিনি ২৫ অক্টোবর থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে জেলায় জেলায় পাল্টা কর্মসূচী ঘোষণার প্রস্তাব করেন। তার এ প্রস্তাবে উপস্থিত প্রায় সব সদস্যই দ্বিমত প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, পাল্টা কর্মসূচী দিয়ে বিরোধী দলকে সংঘাত সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়ার কোন যুক্তি নেই। সবার মতের কারনে প্রচার সম্পাদকের এ প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দল নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাইলে সরকার কঠোর হস্তে তা দমন করবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা সরকারের দায়িত্ব। সরকারের সে ক্ষমতা রয়েছে। এর সঙ্গে দলকে জড়ানোর কোন প্রয়োজন নাই। এখন থেকে দল শুধু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবে।
দলে সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম কুষ্ঠিয়ার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাইরে কথা উঠেছে। দলের যুগ্ম সাধারন সম্পাদককে নিয়ে প্রচার মাধ্যমে নানা তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। তার এই বক্তব্যে স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। এনিয়ে আর কোন সদস্যও কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। বিষয়টি নিয়ে কোন ধরনের মন্তব্য না করে বৈঠকের সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে রাতের খাবারে আমন্ত্রন জানান। এভাবেই শেষ হয় বৈঠকের কার্যক্রম।