নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সমঝোতামূলক সরকারের যে রূপরেখা দিয়েছে তাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি এতে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, এ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইকোর্ট এ ধরনের রূপরেখা দেয়ায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, রায় যা-ই হোক না কেন দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট রয়েছে এতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নির্বাচন যে জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি তার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। যে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তাদের নিয়ে রিট হয়েছে। তাই এ বিষয়ে বিচারপতিরা গাইডলাইন দিতে পারেন। আওয়ামী লীগ যাই বলুক না কেন দেশে যে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট রয়েছে এবং ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়নি তা সামনে এসেছে। আদালত যে গাইডলাইন দিয়েছেন তা শতভাগ মানতে হবে এমনটা নয়। এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে আমরা নির্বাচনকালীন সরকার কী হতে পারে সে বিষয়ে এর থেকে উন্নত কিছু করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিএনপিসহ সব বিরোধী পক্ষের সাথে আলোচনায় বসে সমাধান করতে হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, সারা দেশের মানুষ জানে দেশে কোনো ভোট হয়নি। জনগণের প্রতিনিধি সংসদে যেতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ সংসদ সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। এরপর আদালত ওই নির্বাচন বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। রায় দিয়ে গাইডলাইন হয় না। এটা ঠিক করবে রাজনৈতিক দল জনগণ কী চায় তার ভিত্তিতে। আমার মতে, আদালত যে গাইডলাইন দিয়েছেন সরকার তা ব্যবহার করার সুযোগ পাবে। এটা বাস্তবায়ন করা হলে ভবিষ্যতে আরো একটি নীলনকশার নির্বাচন হতে পারে। যেভাবে হোক বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে তাতে কারো হাত দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না।
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া ফর্মুলার বিষয়ে বিএনপি কোনো মন্তব্য করেনি। দলটির অবস্থানÑনির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে নিরপেক্ষ। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আমরা আলোচনা চাই। আলোচনায় বসলেই নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে, প্রকৃতি কী হবে, চরিত্র কী হবে, এর দায়িত্ব কী হবেÑ তা উঠে আসবে।
অন্য দিকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া পর্যবেক্ষণের কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আদালতের এ পর্যবেক্ষণকে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের কাজ সরকার করবে, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কাজ হচ্ছে যদি কোনো আইন আমরা পাস করি তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কি না তা দেখা। তাই দুঃখের সাথেই বলতে হয় আদালতের ওই বক্তব্য প্রাসঙ্গিক নয়। আর এ বিষয়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আদালত উপন্যাস বা গল্প লেখার জায়গা না। তিনি বলেন, আপনারা ল পয়েন্টে নির্ধারণ করবেন এটা বৈধ না অবৈধ, সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক না অগণতান্ত্রিক।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, নির্বাচন কিভাবে হবে তা সংবিধানেই স্পষ্ট বলা আছে। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট আপনারা বলে দিয়েছেন কয়জনের সরকার হবে। কিন্তু এটা তো আপনার বলার কথা না। নির্বাহী হিসেবে সেটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করবেন।
সম্প্রতি এক রিট আবেদনের রায়ের পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দু’টি ফর্মুলা দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রথম ফর্মুলায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন ৫০ জন মন্ত্রী নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ওই সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা দলগুলো থেকে ভোটের হারের অনুপাতে মন্ত্রী নেয়া হবে। হাইকোর্টের দ্বিতীয় ফর্মুলায় বলা হয়েছেÑ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল প্রথম চার বছর ক্ষমতায় থাকবে। আর সংসদের প্রধান বিরোধী দল সর্বশেষ এক বছর ক্ষমতায় থাকবে। প্রথম ফর্মুলার জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে না। তবে দ্বিতীয় ফর্মুলার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা সংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল গত বছরের ১৯ জুন খারিজ করে দেন। রুল খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি এ রায় প্রকাশ পেয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় পার্টি নেতা খোন্দকার আবদুস সালাম হাইকোর্টে এ রিট আবেদন দায়ের করেন। রিট খারিজের পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ পেয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিধান অবৈধ নয়। নির্বাচনে কোনো প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীর বিজয়ী ঘোষণা করা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। এ কারণেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ সংসদ সদস্যের (এমপি) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
রায়ে এক পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে অসীম বিরোধ সমাধানে কোনো ফর্মুলাই জাতির উপকারে আসবে না যতদিন না/যদি না রাজনৈতিক দলগুলো সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গড়ে তুলতে আন্তরিক ও ঐকান্তিক হয়।
প্রথম ফর্মুলা : হাইকোর্টের দেয়া প্রথম ফর্মুলায় বলা হয়েছে, ৫০ জন নতুন মন্ত্রী নিয়ে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একাদশ সংসদ নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে অথবা সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এ মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের এমপিরা মন্ত্রী হবেন। রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী থাকার অনুপাত নির্ধারণ করা হবে দশম জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো কত শতাংশ ভোট পেয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। তবে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে পাঁচজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী দশম সংসদ নির্বাচন বয়কটকারী দলগুলো থেকে নেয়া যেতে পারে। হাইকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, যেমনÑ স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, আইন, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বণ্টন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে লটারির মাধ্যমে এ মন্ত্রণালয়গুলো বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছেন হাইকোর্ট। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি দ্বাদশ এবং এরপরের নির্বাচনগুলোও এ ফর্মুলায় হতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দ্বিতীয় ফর্মুলা : দ্বিতীয় ফর্মুলায় বলা হয়েছেÑ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল প্রথম চার বছর দেশ শাসন করবে। এর পরের এক বছরের জন্য দেশের ক্ষমতা যাবে প্রধান বিরোধী দলের হাতে। তবে প্রধান বিরোধী দলকে দেশ পরিচালনার ভার দেয়া যাবে শুধু যদি দলটি সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী দলের চেয়ে কমপক্ষে অর্ধেক ভোট পেয়ে থাকে। এরপর প্রথম ফর্মুলা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার নেতৃত্বে গঠিত হবে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা। আর যদি প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলের অর্ধেক ভোটও না পেয়ে থাকে, তবে পাঁচ বছরই দেশ চালাবে ক্ষমতাসীন দল।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, একটি মুক্ত, ন্যায্য ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব। হোক সেটা সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ হওয়ার আগে বা পরে। অনেক সাংবিধানিক কার্যাবলির মধ্যে, যেমনটি আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে লেখা আছে, জাতীয় নির্বাচন ছাড়া কেউই গণতন্ত্র বা আইনের শাসন পরিচালনা ধারণ করতে পারে না। তাই দেশের সব রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো নির্বাচনের আগে একটি নির্বাচনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা ও নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখা এবং একইভাবে নির্বাচন কমিশনকে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া। হাইকোর্ট মনে করেন, ফর্মুলাগুলো হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চিত আক্রমণাত্মক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার উপায়।