নিজামী-বাবর-পরেশসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ
চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় নিজামী-বাবর-পরেশসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া অস্ত্র আটক মামলায় ওই ১৪ জনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এসএম মুজিবুর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১২টায় রায় ঘোষণা শুরু করেন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এসএম মুজিবুর রহমান। সকাল সোয়া ১১টার দিকে মামলার আসামি জামায়াতে ইসলামীর আমির ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন, সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক, চোরাচালানি হাফিজুর রহমান হাফিজ এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। এসময় কঠগড়ায় দাঁড়ানো নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাগ-বিতণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এই দুই নেতা। একপর্যায়ে কাঠগড়ার পাশে রাখা একটি বেঞ্চে বসেও পড়েন তারা। পরে কাঠগড়ার ভেতরে চেয়ারের ব্যবস্থা করা হলে তারা কাঠগড়ায় ওই চেয়ারে গিয়ে বসেন। কাঠগড়ায় উপস্থিত বাকি আসামিরা অবশ্য দাঁড়িয়ে আছেন। এ মামলায় আসামি হয়ে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী (৮২), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর (৫৩), এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী (৬০) ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম (৬১), সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ (৫৩), সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন (৪৩), সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন (৪৭), সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার (৬২), সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক (৬১), চোরাচালানি হাফিজুর রহমান হাফিজ (৪৮) এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ (৪৫)সহ আরো ৩৯ জন। এই মামলা দু’টিতে রাষ্ট্রপক্ষে রয়েছেন আইনজীবী ও মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন এবং আসামি পক্ষে রয়েছেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ । এদিকে বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আলোচিত আসামি মতিউর রহমান নিজামী, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক চার কর্মকর্তাকে। মামলার রায়কে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম আদালত পাড়া ও আশপাশের এলাকাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালত পর্যন্ত এলাকায় বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা থেকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ওই আদালতের বিচারক এসএম মুজিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনেও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া নাশকতার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। সিএমপি সূত্রে জানা যায়, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়কে ঘিরে নগরীতে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদরদপ্তর থেকে মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে সিএমপি। পুলিশের পাশাপাশি রায়কে ঘিরে থাকছে র্যাব, পুলিশ ও আমর্ড পুলিশ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিজিবিও। নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (সদর) মাসুদ উল হাসান বাংলামেইলকে বলেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রায়কে ঘিরে যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। পাশপাশি র্যাব-আর্মড পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে।’ নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) রেজাউল মাসুদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ভোর থেকে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে প্রায় দশ প্লাটুন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আদালতের প্রত্যেকটি প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। আদালতের আশপাশে উঁচু ভবনগুলোতে, ফুটওভারের উপরে আর্মড পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’ পুলিশ জানায়, বায়নোকুলার ও ক্যামেরা নিয়ে রয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। এছাড়া চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আদালত ভবনে আসামিদের নেয়ার পথে সব উঁচু ভবনের ছাদে আর্মড পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সাময়িকভাবে ওই সড়কে যানবাহন চলাচলও শিথিল রাখা হয়েছে। এছাড়া আদালত ও কারাগার ঘিরে পুলিশ ও র্যাবের একাধিক টিমের টহল অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে বিচারকের এজলাশ ও বাসভবনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল নগরের সিইউএফএল জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। আটক দশ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল উজিগান, টমিগান, এসএমজি, এমএমজিসহ ১ হাজার ৭৯০টি বিভিন্ন ধরনের অগ্নেয়াস্ত্র, ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০টি গুলি, ৬ হাজার ৩৯২টি গুলির ম্যাগাজিন, ২৪ হাজার ৯৯৬টি গ্রেনেড এবং ১৫০টি রটেক ল্যাঞ্চার। নগরের কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান বাদী হয়ে অস্ত্র আটক ও চোরাচালান আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিল। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় চোরাচালন এবং ১৮৭৮ সালের ১৯(এ) ধারায় অস্ত্র আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান। পরে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার একেএম কবির উদ্দিন, মীর নওশের আলী, ইসমাঈল হোসেন ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান চৌধুরী। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার অভিযোগপত্রে রয়েছে ২৬৫ সাক্ষী। এরমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৬ জন। এরমধ্যে পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট। সাক্ষীদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব, গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও রয়েছেন। ২০০৪ সালের ১২ জুন হাফিজুর রহমান ও দ্বীন মোহাম্মদকে প্রধান আসামি করে প্রথম দু’টি মামলায় ৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডি। একই বছরের ১৯ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি। সাক্ষ্যগ্রহণ চলতে থাকে। আদালত বৈরীও ঘোষণা করেন ২০ সাক্ষীকে। ২০০৭ সালে আদালত অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিলে তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৩ জুন তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন সিআইডি। যেখানে বাবর ও নিজামীসহ নতুন করে ১১ জনকে আসামি করা হয়। সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসা নতুন ১১ আসামি বাবর-নিজামীর বিরুদ্ধে আদালত ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করেন। এর আগে ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল ৪৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগগঠন করেন আদালত। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় গত বছরের অক্টোবরে। ১ হাজার ২০০ পৃষ্ঠা জুড়ে সাক্ষী ও জেরা রেকর্ড করেন বিচারক। ৩৪ কার্যদিবস তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় চারজনের মৃত্যুর পর বর্তমানে অস্ত্র আটক মামলায় আসামি হিসেবে আছে ৫০ জন এবং চোরাচালান মামলায় ৫২ জন। জানা যায়, অস্ত্র আটক মামলার আসামিদের মধ্যে ১১ জন হাজতে, ২৭ জন আসামি জামিনে এবং ১২ জন পলাতক আছেন। হাজতে থাকা আসামিরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন, সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, সাবেক জিএম (প্রশাসন) একেএম এনামুল হক, চোরাচালানি হাফিজুর রহমান হাফিজ এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ। পলাতক আসামিরা হলেন- উলফার সামরিক কমাণ্ডার পরেশ বড়ুয়া, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন, প্রদীপ কুমার দাশ প্রকাশ ব্রজগোপা, নূরনবী, সিরাজুল ইসলাম, হেলাল উদ্দিন, বাবুল মিয়া, আব্দুর রহিম মাঝি, আব্দুস সবুর, মো. শাহআলম, মো. সোবহান ও শাহজাহান। এই দু’টি মামলায় দীর্ঘ দিনের বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত ১৩ জানুয়ারি বিচারক ৩০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রাখেন। |