নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

11/05/2016 9:56 amViews: 29
নিজামীর ফাঁসি কার্যকর
নিজামীর ফাঁসি কার্যকর
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির ও একাত্তরের বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টা এক মিনিটে (কারাগারের ঘড়ি অনুযায়ী) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এ দণ্ড কার্যকর করা হয়। জল্লাদ রাজুর নেতৃত্বে ১০ জন জল্লাদ এ কাজটি সম্পন্ন করেন। ২০ মিনিট ধরে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে থাকার পর নিজামীর নিথর দেহ নীচে নামিয়ে আনা হয়।
ঢাকার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সালাউদ্দিন, সিভিল সার্জন আবদুল মালেক মৃধা, ভারপ্রাপ্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল ইকবাল হাসান, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর, জেলার নেসার উদ্দিন ও পুলিশ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে তার পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। এরপরই ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় মুড়িয়ে কফিনে ভরা হয় মরদেহ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কড়া প্রহরায় গতকাল রাতেই নিজামীর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মন্মথপুরে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগাম খবরে গতকাল সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ভীড় করে হাজার হাজার উত্সুক মানুষ। কারো হাতে ছিল নিজামীর ফাঁসি সম্বলিত ছবির প্লাকার্ড। গতকাল রাতে জেলগেট দিয়ে নিজামীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স বের হলে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশ প্রকম্পিত করে জনতা। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর বদর বাহিনীর প্রধানের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে।
কারাসূত্র জানায়, মতিউর রহমান নিজামীকে চূড়ান্ত রায় পড়ে শোনানোর পর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, মতিউর রহমান নিজামী প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি।
এরপরই কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির রায় কার্যকর করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়।
নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে এ নিয়ে পাঁচজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। এর আগে গত ২১ নভেম্বর একই মঞ্চে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল।
২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্ল­া ও ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও আলবদর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসিও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়।
নিরাপত্তা জোরদার
মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের বাইরে ও আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিপুল সংখ্যক র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সেখানে অবস্থান নেন। কারাগারের আশেপাশের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। সাধারণ মানুষের চলাফেরা সীমিত করতে আশেপাশের সড়কগুলোতে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়। কারাগারের মূল ফটকের সামনে মোতায়েন করা হয় একটি এপিসি। চাঁনখারপুল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পর্যন্ত সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের বাইরে গণমাধ্যম কর্মীরা অবস্থান নেয়। নিরপত্তা জোরদার করতে গতকাল রাতে রাজধানীতে বিজিবির টহল চলে।
কারা কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি
কারাসূত্র জানায়, গতকাল বিকাল পৌনে চারটার দিকে ফাঁসির মঞ্চ ঘিরে প্যান্ডেল করা হয়। লাল-সবুজের সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় মঞ্চ।  রাত ৯টায় সেখানে বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া হয়। মঞ্চের ওপর টানানো হয় সামিয়ানা। ফাঁসির মঞ্চের পশ্চিম ও পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ছিল ১২ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। সন্ধ্যার দিকে কারাগারের সকল সেলে নিরাপত্তার জন্য লকগুলো ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে কারা কর্তৃপক্ষ।
গতকাল সকাল ১০টার পর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক (প্রিজন) কর্নেল ইকবাল হাসান ও ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর তারা বেরিয়ে আসেন। এরপর ফাঁসির রায় কার্যকর করা নিয়ে গতকাল দুপুরে কারা অধিদফতরে এক বৈঠক হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কারা অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক (প্রিজন) কর্নেল  ইকবাল হাসান, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার ও ঢাকা কারাগারের  সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর, জেলার নেহার আলমসহ ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তারা।
নিজামীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা
কারা হাসপাতালের চিকিত্সক গতকাল দুই দফায় মতিউর রহমান নিজামীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। চিকিত্সক জানিয়েছেন, নিজামী সুস্থ আছেন। গত সোমবার রাতে মতিউর রহমান নিজামীকে গাজীপুরের কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। ওই রাতেও তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।
কারাসূত্র জানায়, গতকাল সকালে মতিউর রহমান নিজামী নাস্তা খেয়েছেন। দুপুরের খাবারও সময়মতো খেয়েছেন। তবে গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় তাকে ভীষণ বিমর্ষ লাগছিল।
রাজুর নেতৃত্বে জল্লাদ বাহিনী
গতকাল বিকাল তিনটার দিকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে  ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা  হয়  প্রধান জল্লাদ রাজুকে। কারা বিধি অনুসারে, একটি ফাঁসির রায় কার্যকর করতে দশজন জল্লাদ অংশ নেন। অপর জল্লাদরা হলেন আব্দুস সাত্তার, আবুল, হযরত, রনি, ইকবাল, মাসুদ, মুক্তার, আব্দুল ওহাব ও ওমর আলী শেখ।
সালাহউদ্দিন কাদের  চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকরেও ছিলেন রাজু জল্লাদ। কারা সূত্রে জানা গেছে, ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে জল্লাদ শাহজাহান, রাজু ও জনি অন্যদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তবে শাহজাহানের বয়স বেশি হওয়ায় এবার তাকে রাখা হয়নি।
ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার আগে:
গতকাল সন্ধ্যার পর-পরই মতিউর রহমান নিজামী গোসল সেরে নেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিনি রাতের খাবার খান। এরপর রাত ৮টার দিকে তার সঙ্গে স্বজনরা দেখা করতে আসেন। রাত ১০টার দিকে কারা মসজিদের পেশ ইমাম মওলানা মনির হোসেন তাকে তওবা পড়ান। সেখানে নিজামী দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। ফাঁসি কার্যকরের কিছু আগে চারজন জল্লাদ কনডেম সেলে নিজামীর দুই হাত পিছ মোড়া করে বেঁধে দেন। এরপর তার মুখমণ্ডলে জমটুপি পরিয়ে দেন। দুই জন জল্লাদ দুই দিকে ধরে তাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যান। ফাঁসির মঞ্চের পাটাতনে দাঁড়ানোর পর দুই জল্লাদ নিজামীর দুই পা বেঁধে দেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর একটি সাদা রুমাল তার হাত থেকে মাটিতে ফেলে দেন। প্রধান জল্লাদ রাজু মঞ্চের লিভার (হাতল বিশেষ) ধরে টান দিলে মঞ্চের পাটাতন সরে গিয়ে ম্যানিলা রশিতে নিজামী ঝুলতে থাকেন। প্রায় ২০ মিনিট ঝুলে থাকার পর নিজামীর নিথর দেহ নীচে নামানো হয়।
পেছনের কথা
উল্লেখ্য, গত ৫ মে  মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত  জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সাজা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ। এরপর গত সোমবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম (রজনীগন্ধা) সেলে থাকা নিজামীকে রায় পড়ে শোনান  সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবীর। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি গোলাম হায়দার।

Leave a Reply