নিউ ইয়র্ক ফেডের দিকে আঙুল আতিউরের
নিউ ইয়র্ক ফেডের দিকে আঙুল আতিউরের
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থার ত্রুটির জন্যই ফেব্রুয়ারিতে রাজকোষ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে তিনি আঙুল তুলেছেন নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভের দিকে, যেখানে গচ্ছিত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ। ঢাকায় নিজ বাড়িতে এ সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মেঘা বাহরিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ক্ষতির ঘটনাটি ছিল পদ্ধতিগত ব্যর্থতা (সিস্টেমিক ফেইলিউর)। তার মতে, ‘পুরো চক্রে (চেইন) কিছু একটা ভুল চলছিল। তার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করা উচিত নয়।’ বিশেষ করে তিনি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ককে দায় দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি যদি ৫০০ ডলার উঠাতে চান, তাতেই আপনাকে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এখানে লাখ লাখ ডলার চলে যাচ্ছে, আপনি কোনো প্রশ্নই তুলছেন না।’ নিউ ইয়র্ক ফেডের বাংলাদেশে গভর্নর বা কারও সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কমিউনিটিতে অনেকদিন ধরে থাকা আশঙ্কার প্রতিই ছিল আতিউর রহমানের ইঙ্গিত। কারণ, বিশ্বব্যাপী ব্যাংক, কোম্পানি ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে অর্থ স্থানান্তর করে, তার মধ্যেই থাকা দুর্বলতা উদঘাটিত হয় রাজকোষ চুরির ঘটনায়। বিশ্বজুড়ে অর্থ স্থানান্তরের জন্য ব্যবহৃত সুইফট মেসেজিং সিস্টেম ব্যবহার করেই নিউ ইয়র্ক ফেডে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেয় সাইবার অপরাধীরা। তবে ওই ঘটনার পর সুইফট বলেছে, বৈশ্বিক ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে অর্থ চুরির একই ধরনের আরও প্রচেষ্টাও তারা দেখতে পেয়েছে। নিউ ইয়র্ক ফেড আতিউর রহমানের এ মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে ফেডের এক মুখপাত্র বলেছেন, তাদের কম্পিউটার সিস্টেমে কোনো অনুপ্রবেশের কারণে চুরির ঘটনা ঘটেনি। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন যে চুরির ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতার কারণেই ঘটেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবহৃত রাউটারটি ছিল ১০ ডলার সমমূল্যের। কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ছিল না কোনো ফায়ারওয়াল। তবে এ দাবি মানতে রাজি নন আতিউর। তিনি বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তাকে আমি শীর্ষ এজেন্ডা বানিয়েছি। আমি এক বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি সমস্যা হতে পারে। আমার দুর্ভাগ্য যে, এটি ঘটেছে এখন।’ অনুপ্রবেশ উদঘাটনে কিছু সদস্য ব্যাংকের মন্থরগতি নিয়ে হতাশ সুইফট নির্বাহীরাও। ব্যাংকগুলো এমন হামলার শিকার হলেও তা সুইফটে যথাসময়ে জানানো হয়। একটি ঘটনায় এক ব্যাংক সাইবার হামলার কথা জানাতেই ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের কাছে সুইফট কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে যেসব ব্যাংক মৌলিক সাইবার নিরাপত্তা বজায় রাখতে না পারবে, তাদের হয়তো সুইফট থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দুনিয়ার কিছু নির্দিষ্ট অংশকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। সুইফটের এক মুখপাত্রও আতিউরের মন্তব্য নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। কিন্তু তিনি বলেছেন, কিছু গ্রাহকের নিরাপত্তা দুর্বলতা অন্য ব্যাংকের ওপরও প্রভাব ফেলে। এ কারণে পুরো ইন্ডাস্ট্রিকেই নিজেদের নিরাপত্তা নবায়ন ও বৃদ্ধিতে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে। আতিউর বলেছেন, একটি তদন্ত চলছে। ব্যাংকের ভেতরও অবহেলা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বলেছেন, কোনো অনিয়মের জন্য তিনি দায়ী নন। তিনি বলেন, ‘গভর্নর হিসেবে আমার ওপর প্রত্যেক ছোট ছোট ব্যাপার দেখাশোনার দায় বর্তায় না। হয়তো কারও পাসওয়ার্ড চুরি হয়েছে। এটা বিভাগীয় ব্যর্থতা, গভর্নরের দোষ নয়। এটা অনেক বড় ধরনের হামলা, অনেকটা ১৫ রিখটার স্কেল মাত্রার! অন্য পক্ষরাও বাংলাদেশকে সহায়তা বা সতর্ক করে দিতে পারতো। আপনি আমার স্তব্ধতা অনুমানও করতে পারবেন না।’ ব্যাংকের ভেতরই কেউ হ্যাকারদের সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে, এমন গুঞ্জনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো অপরাধী থেকে থাকে, তাকে ধরুন। কিন্তু কাউকে কোনো কারণ ছাড়া দোষ দেয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, চুরির ঘটনার পর আমি পদত্যাগ করেছি ব্যাংকের বৃহত্তম মঙ্গলের স্বার্থে। তবে চুরির পরে নিজের কর্মকাণ্ডের পক্ষাবলম্বন করেছেন তিনি। কিন্তু এক মাস ধরে চুরির ঘটনা না জানানোয় সমালোচিত হয়েছেন সাবেক এ গভর্নর। তার মতে, ‘আমি আর্থিক খাত রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম আমার দেশের ইমেজ রক্ষা করতে।’ তবে চুরির ঘটনার পর আমেরিকান নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান যেমন-ম্যান্ডিয়ান্টকে ঘটনা তদন্তে নিয়ে আনেন তিনি। তার মতে, ‘এটা হয়তো ভুল ছিল, কিন্তু অপরাধ নয়। মানুষের এ ধারণা রাখা উচিত নয় যে আমি প্রযুক্তিগতভাবে এত স্মার্ট হব যে প্রথম থেকেই জানব কী ঘটেছে।’ তার যুক্তি, হ্যাকারদের পাঠানো ভুয়া নির্দেশনা যাচাই করতে যথেষ্ট কিছু করেনি নিউ ইয়র্ক ফেড। তার ভাষ্য, ‘ফেডের পক্ষ থেকে সক্ষমতার মারাত্মক ঘাটতি ছিল। আমরা মেইল, ফ্যাক্স পাঠাচ্ছি। কিন্তু কেউই ধরছিল না। আমাদের হটলাইন দরকার।’ মে মাসে, ফেড, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সুইফটের প্রতিনিধিরা সুইজারল্যান্ডের বাসেলসে একত্রিত হন। এ ধরনের হামলা থেকে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক আর্থিক খাতকে সুরক্ষিত করতে আলোচনা করেন তারা। আতিউর রহমান কিছুটা দায় ফিলিপাইনের ওপরও দিয়েছেন। ফিলিপাইনেই হ্যাকাররা টাকা পাঠিয়ে দেয়। সমালোচকরা বলছেন, ফিলিপাইনের অর্থ পাচার বিরোধী প্রক্রিয়ার মধ্যে ফাঁক-ফোকর আছে। আতিউর বলেন, ‘যদি ফেড সত্যিই সাহায্য করতে চায়, তাহলে তারা ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের কাছে একটি ফোন কল করবে এবং অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ পাঠাবে। কারণ, সিস্টেমের গ্রহণযোগ্যতাই এখানে হুমকির মুখে।’ তিনি বলেন, ফিলিপাইন যদি ঠিকভাবে আচরণ না করে, তবে এফএটিএফ কর্তৃক কালোতালিকাভুক্তি প্রাপ্য তাদের। তারা এখন পর্যন্ত খুবই মন্থর। যদি বৈশ্বিক বড় বড় সংস্থাগুলো এসব না দেখে, তাহলে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন নিয়ে এত হইচই ছোট দেশগুলোতে কৌতুক হিসেবে বিবেচিত হবে।’ এফএটিএফ’র একজন মুখপাত্র এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন যে, তাদের কোনো তদন্তমূলক বা বিচারিক কার্যাবলী নেই। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো তেতাঙ্গকো জুনিয়রের একজন মুখপাত্র এক ইমেইল প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থ চুরির সঙ্গে জড়িত বলে যারা চিহ্নিত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আমরা আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।’