নিউজিল্যান্ডকে এরদোগানের হুঁশিয়ারি মুসলিম বিরোধিতায় তুরস্কে গেলে কফিনে ফিরতে হবে
নিউজিল্যান্ডকে এরদোগানের হুঁশিয়ারি
মুসলিম বিরোধিতায় তুরস্কে গেলে কফিনে ফিরতে হবে
ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলায় নিউজিল্যান্ডকে সতর্ক করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের গ্যালিপোলিসে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল জোটবাহিনী। তিনি সে প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন সামনে। মসজিদে হামলার বিষয়ে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। বললেন, যারাই মুসলিম বিরোধিতায় তুরস্কে প্রবেশ করবে তাকেই কফিনে করে ফেরত যেতে হবে, যেমনটা তাদের পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। হুরিয়েত নিউজ সাইটকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ড সহ তাদের মিত্ররা গালিপোলিস উপদ্বীপে আগ্রাসন চালিয়েছিল।
তাতে ব্যর্থ হয় তারা।
সেই প্রসঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এরদোগান। আর তাই জোরালো কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেছেন, যদি কেউ তুরস্ক, মুসলিম এবং নিষ্পেষিতদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলে সে যেই হোক না কেন ‘নতুন ইতিহাস লিখবে তুরস্ক’। তিনি নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী ও পশ্চিমাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আপনাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন। তাদের অনেকে ফিরে গেছেন কফিনে করে। যদি আপনারা আপনাদের সেই পূর্বপুরুষদের মতো আসতে চান তাহলে নিশ্চিত থাকুন পরিণতি হবেন তাদের মতোই।
৩১ মার্চ তুরস্কে স্থানীয় নির্বাচন। এর প্রচারণায় তিনি গ্যালিপোলিসের কাছে কানাক্কালেতে বক্তব্য রাখছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেখানে জোটবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। তারই একটি ইভেন্টে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। এরদোগান সেখানে বলেন, মুসলিমদের শত্রুরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা অব্যাহতভাবে আমাদের ঘৃণা করে। তারা ১৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরের নিউজিল্যান্ড থেকে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে। সেখান থেকে তারা আমাদেরকে একটি বার্তা দিচ্ছে। ওই হামলা ব্যক্তিবিশেষের নয়। হামলা চালানো হয়েছে সংগঠিত উপায়ে।
এর আগে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন করেন। তাতে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামভীতির বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়।
ওদিকে নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টোন পিটারসের ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে হামলা নিয়ে সরকারগুলোর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। তিনি এরই মধ্যে বলেছেন, তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওকতাই এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলুর সঙ্গে রোববার রাতে কথা বলেছি আমি। ভিনদেশী একজন ব্যক্তি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে ক্রাইস্টচার্চে। এ বিষয়ে আমরা নিন্দা প্রকাশ করেছি। তা নিয়ে এবং ঘটনায় নিউজিল্যান্ড কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ওদিকে অনলাইন বিবিসি লিখেছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান হামলার ভিডিও দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন বলে সমালোচনা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার ভয়ংকর ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কোন কোন গণমাধ্যম এই ভিডিওটি দেখানোর পর এর তীব্র সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এই ভিডিওটি দেখাচ্ছেন। এ মাসের শেষের দিকে তুরস্কে যে স্থানীয় নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচন সামনে রেখে তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।
রোববার টেকিরডাগ শহরে এক সমাবেশে তিনি ভাষণ থামিয়ে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সংঘটিত হত্যাকান্ডের ছবি এক বিশাল পর্দায় ফেলে দেখান। এরপর তিনি বলেন, বিশ্বের সব নেতা এবং সংস্থা, এদের মধ্যে জাতিসংঘও আছে, তারা এই হামলাকে ইসলাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলা বলে মনে করে। কিন্তু তারা কেউ বলছে না- এই হামলাকারী একজন খ্রিস্টান সন্ত্রাসবাদী। যদি হামলাকারী একজন মুসলিম হতো, তারা তাকে একজন ইসলামী সন্ত্রাসবাদী বলে বর্ণনা করতো।
এরদোয়ান ভিডিওটির যে অংশটি দেখিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, হামলাকারী মসজিদে ঢুকছে এবং গুলি চালাতে শুরু করেছে। ওই হামলায় কমপক্ষে প্রথম ২৪ ঘন্টায় তুলে নিয়েছে। আর ভিডিওটির এডিট করা যে অংশগুলোতে সেরকম বিচলিত হওয়ার মতো দৃশ্য নেই, সেগুলোও তারা এখন ডিলিট করছে।
তুরস্কে ৩১ মার্চ স্থানীয় নির্বাচন। বিবিসির সংবাদদাতা মার্ক লোয়েন মনে করেন, এই নির্বাচনের আগে প্রকাশ্য জনসভায় ভিডিওটি দেখিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার সমর্থকদের উজ্জীবীত এবং ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছেন। এরদোগান তার ভাষণে বলেন, ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার জন্য ব্রেনটন টেরেন্ট বলে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সে একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। সেই ইশতেহারে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তুরস্কের কথা এবং ইস্তাম্বুলের হাগিয়া সোফিয়ার কথা উল্লেখ ছিল।
হাজিয়া সোফিয়া ছিল একসময় একটি গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ। অটোমান সা¤্রাজ্যের অধীনে এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। তবে এটি এখন কেবল একটি যাদুঘর। এরদোগান বলেছেন, ক্রাইস্টচার্চের এই হত্যাকারী দু’বারতুরস্কে যায় ২০১৬ সালে। মোট ৪০ দিনের বেশি তুরস্কে ছিল। তার সেই সফরের ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, মুসলিমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে এ ধরণের হামলা চালাতে পারবে না। কিন্তু যদি মুসলিমরা সংগঠিত না হয়, তারা এমন হামলা চালাতে পারবে। কাজেই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা একে অন্যের দেখাশোনা করবো।
এই ভাষণের সময় প্রেসিডেন্ট এরদোগান তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কামাল কিলিচডারুগলোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যারা ইসলামকে ঘৃণা করে, তিনি তাদের পক্ষ নিচ্ছেন। তবে কামাল কিলিচডারুগলোর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সমর্থকরা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগান আসলে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার জন্য এই ভিডিওটি ব্যবহার করছেন।
বিবিসির মার্ক লোয়েন বলছেন, তুরস্কের গণমাধ্যম, যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারপন্থী, তারা এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট এরদোগানকেই সমর্থন করছে। তারা দেখাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইসলামোফোবিয়ার জোয়ার থেকে মুসলিমদের রক্ষার চেষ্টা করছেন। তুরস্কের একটি পত্রিকার শিরোনাম এরকম: ‘আমরা নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছেন যারা, তাদের পাশে আছি, পশ্চিমা দুনিয়া নীরব।’
আরেকটি পত্রিকায় একটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ প্রকাশ করে দাবি করা হচ্ছে, পশ্চিমা নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির যোগসাজশ ছিল এই ঘটনায়। মার্ক লোয়েন বলছেন, এরদোগানের আসলে নির্বাচনে জেতার জন্য যে রক্ষণশীল ধার্মিক ভোটারদের সমর্থন দরকার, তার এসব কথা-বার্তা তাদের খুশি করবে। কিন্তু অন্যদিকে আবার তুরস্কের সমাজের অপর অংশ, যারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমাপন্থী, তাদের ক্ষোভ এবং হতাশা আরও বাড়বে।