না’গঞ্জে শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিচার্জ আহত অর্ধশত ঢাকা-গাজীপুর শান্ত ॥ সাভার ঘোলাটে করার অপচেষ্টা বিজিবি টহলে ভেস্তে গেছে ॥ ১৫ গার্মেন্টস বন্ধ
স্টাফ রিপোর্টার ॥ কঠোর পদক্ষেপ আর সর্বোচ্চ সতর্কতায় রাজধানীর পোশাক কারখানাগুলোর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীতে শ্রমিকরা চেষ্টা করেও অবরোধ-বিক্ষোভের মতো বড় ধরনের কোন কর্মসূচী পালন করতে পারেনি। রাজধানীর বাইরে গাজীপুরও ছিল মোটামুটি শান্ত। তবে নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবরোধ-বিক্ষোভ দমন করা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে সাংবাদিক-পুলিশসহ প্রায় অর্ধশত আহত হয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোড তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখা হয়। সাভারেও কতিপয় শ্রমিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিজিবির ব্যাপক টহলে সেটা সম্ভব হয়নি। বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান কচি জানান, মালিকের সহনশীলতা, ধৈর্য ও সরকারের কঠোর পদক্ষেপে রাজধানীতে পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। তবে কোনাবাড়ি, সাভার ও আশুলিয়ায় সব মিলিয়ে গোটা ১৫ কারখানা বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি দু’একদিনে আরও উন্নতি হবে।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, যে কোন মূল্যে পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে-নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সকালে তেজগাঁও লিংক রোডের সবচেয়ে বড় পোশাক কারখানার সামনে ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ। শ্রমিকরা সকালে কর্মস্থলে প্রবেশের সময় বেশ সতর্ক অবস্থানে থাকে পুলিশ। দুপুরে খাবারের জন্য শ্রমিকরা বাইরে আসার সময়েও পুলিশ তাদের জড়ো হতে দেয়নি। সেপালের মালিক টিপু মুন্সি এমপি বলেছেন, পরিস্থিতি বৃহস্পতিবার ছিল মোটামুটি শান্ত। প্রয়োজনীয় পুলিশী টহলের দরুন স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। তবে পর পর তিনদিনের বিশৃঙ্খলায় এ কারখানার উৎপাদনে মারাত্মক বিঘœ ঘটেছে। চলমান সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে টিপু মুন্সি বলেন, সরকার মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা তো হতে হবেই। আলোচনা চলছে। একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
এ আন্দোলনে বাইরের কোন অশুভ শক্তির মদদ আছে কিনা জানতে চাইলে টিপু মুন্সি জানান, তাঁর কারখানার শ্রমিকদের বেশিরভাগই মোটামুটি শান্ত প্রকৃতির। দাবি নিয়ে কিছু শ্রমিকরা চেষ্টা করে কিছু করার। এ ক্ষেত্রে কারোর কোন মদদ আছে কিনা সেটা তদন্তের ব্যাপার।
সেপাল গার্মেন্টেসের মতোই একই ধরনের চিত্র দেখা দেখা গেছে, রামপুরা উত্তর, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর বনানী ও ধানম-ি এলাকাসহ নগরীর অন্যান্য এলাকার কারখানাগুলোতে। অধিকাংশ কারখানার আশপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করায় বৃহস্পতিবার কোথাও তেমন কোন অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। কয়েকটি এলাকায় শ্রমিকরা কারখানার বাইরে এসে পরিস্থিতি ঘোলাটে বা অবরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এ কৌশল বজায় রাখা হবে যতদিন পরিস্থিতি শান্ত না হয়।
বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান কচি জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি মালিক-শ্রমিকদেরও যৌথ প্রচেষ্টায় রাজধানীতে তেমন কিছু ঘটেনি। পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য বিজিএমইএ সব সময় সরকারকে সহযোগিতা করে আসছে এবং সেটা অব্যাহত থাকবে।
রুমন রেজা, স্টাফ রিপোর্টার নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, ফতুল্লায় তৃতীয়দিনের মতো ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকার দাবিতে পোশাক কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শিল্প পুলিশের ওসিসহ ২০ পুলিশ সদস্য, সাংবাদিক, শ্রমিক, পথচারীসহ আহত হয়েছে কমপক্ষে অর্ধশত। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টাধাওয়া সংঘর্ষে পুরো কাঠেরপুল এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে পুলিশ পিছু হটলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। অন্যদিকে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত সাড়ে তিন ঘণ্টা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। পরে পুলিশ শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। ভাংচুর করা হয়েছে ২০-২৫টি যানবাহন।
এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে বাসদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক নিখিল দাস এবং সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের জেলা সংগঠক সেলিম মাহমুদ ও জাহাঙ্গীর আলম এক বিবৃতিতে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করার দাবি জানান।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে রাখে। এর আগে সকাল থেকে ফতুল্লার শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে শুরু করে। তবে কাঠেরপুর এলাকার টাইম সোয়েটার, লামাপাড়া এলাকার ইউরো টেক্স ও কুতুবআইল এলাকার সিক গার্মেন্টস শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এলেও তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফতুল্লার কাঠেরপুর এলাকার রফতানিমুখী পোশাক কারখানা পলমল, মাইক্রোফাইবার ও লিবার্টি কারখানার ভেতরে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা কারখানার ভবনের ছাদের ওপর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জবাবে পুলিশ শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাসা-বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের টিয়ারশেলের গন্ধ। দুপুর একটার দিকে পুলিশ পিছু হটলে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে। এ সময় ফতুল্লার পোস্টঅফিস-হাজীগঞ্জ সড়কের বিভিন্নস্থানে গাছের গুঁড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশও শ্রমিকদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা চলে সংঘর্ষ। ধাওয়া পাল্টাধাওয়া সংঘর্ষে শিল্প পুলিশের পরিদর্শক রেজাউলসহ ২০ পুলিশ সদস্য, ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক তাপস সাহা, শ্রমিক, পথচারীসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনায় শ্রমিকরা ছিল মারমুখী।
এদিকে দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোড থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সেখানেও পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়। এ সময় শ্রমিকরা ২০-২৫টি যানবাহন ভাংচুর করে। পুলিশ টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। সকাল থেকে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে হাজার হাজার যাত্রী।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটো গাজীপুর থেকে জানান, এখানকার অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা বৃহস্পতিবার কাজে যোগ দিলেও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ২০ কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে নিরাপত্তা রক্ষায় র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি ৩ প্লাটুন বিজিবি (বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ) মোতায়েন করা হয়েছে। ভোর থেকেই এ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে টহল দিচ্ছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত বলা যায়।
পুলিশ, শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানায়- ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করা ও জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় নূর গ্রুপের চারটি কারখানা ও পল্লীবিদ্যুত এলাকার স্টারলিংক কারখানায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তারা কাজে যোগ দিতে না চাইলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবারের জন্য কারখানাগুলো ছুটি ঘোষণা করেছেন। এছাড়াও কালিয়াকৈরের হরিণহাটিতে এ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুত এলাকার ইন্টারস্টপ এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানা, নায়াগ্রা কারখানা ও মৌচাক এলাকার লগুজ কারখানাসহ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে ওইসব এলাকারও অন্তত ২০টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
টঙ্গী থেকে নুরুল ইসলাম জানান, শিল্পঞ্চলের পুরো এলাকায় ব্যাপক পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েনের পর থেকে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি ছিল-তা একেবারেই কমে গেছে। কারখানাগুলাতে বৃহস্পতিবার শান্ত অবস্থান বিরাজ করছে। তবে কারখানা মালিকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সকালের দিকে পোশাক শ্রমিকদের একটি বিক্ষোভ মিছিল চেরাগআলী মার্কেট হয়ে টঙ্গীবাজার গিয়ে শেষ হয়। এ সময় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ ॥ সৌমিত্র মানব সাভার থেকে জানান, বৃহস্পতিবার সকালে থেকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জিরানী ও আশুলিয়ার নিজ নিজ কারখানার সামনে ৮ হাজার টাকার বেতন-ভাতাদির দাবিতে জড়ো হয়। একপর্যায় দলে দলে সকল শ্রমিক নবীনগর-চন্দ্রা সড়কের জিরানী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। সকালে পানিশাইলের মাছিহাতা গার্মেন্টসহ ২টি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করে জিরানী বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসতে থাকে। জিরানী বাজারসংলগ্ন কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সকালে কাজে এসে কারখানা বন্ধের নোটিস দেখতে পেয়ে কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এ সময় সড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পুলিশ প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চেষ্টার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
শিল্প পুলিশের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কিছু বিক্ষুব্ধ শ্রমিক বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।