নতুন বছরে আলোচনায় থাকবে যেসব প্রযুক্তি
বছর বছরই এখন প্রযুক্তিবিশ্বে হাজির হচ্ছে নতুন নতুন সব প্রযুক্তি। একদম আনকোরা প্রযুক্তির দেখা না মিললেও আগের বছরগুলোর প্রযুক্তিতেই যুক্ত হচ্ছে নতুন এমন সব উপাদান, যাতে তা নতুন প্রযুক্তির মতো করেই হাজির হয় বিশ্বের সামনে। গেল কয়েক বছরেই এমন নতুন নতুন সব প্রযুক্তির দেখা পেয়েছে বিশ্ব। প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সেই ধারা অব্যাহত থাকবে এ বছরেও। বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ থেকে নতুন এই বছরে যেসব প্রযুক্তি রাজত্ব করবে তার কয়েকটির কথা জানাচ্ছেন তরিকুর রহমান সজীব
গেল বছরের জুলাইয়ে ফেসবুক প্রধান মার্ক জুকারবার্গ তো বলেই ফেললেন, প্রযুক্তি একটা সময় এমন অবস্থানে পৌঁছে যাবে যে মানুষ মনে মনেই একে-অন্যের সাথে কথা বলতে পারবে। এ তো দূর ভবিষ্যতের কথা। আগামী কয়েক বছরের প্রযুক্তি প্রবণতার কথা মাথায় রেখে কিছুদিন আগে প্রথম ওয়েব ব্রাউজার মোজাইকের নির্মাতা ও বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মার্ক অ্যানড্রেসেন আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ২০২০ সালের মধ্যে সব ধরনের প্রযুক্তি পণ্যেই যুক্ত থাকবে চিপ এবং এগুলোর সবই যুক্ত থাকবে ইন্টারনেটে। আসলে যেভাবে সময়ের সাথে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে, তাতে করে প্রযুক্তির ভবিষ্যত্ নিয়ে বলতে গেলে তা অনেক ক্ষেত্রেই কল্পলোকের কাহিনী মনে হতে পারে। রাতারাতি অবশ্য এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই; ক্রমে ক্রমে প্রযুক্তি যে সেই স্থানে পৌঁছে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কারও। প্রযুক্তি উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নতুন শুরু হওয়া বছরে কোন প্রযুক্তিগুলো প্রযুক্তিবিশ্বে আলোচনার শীর্ষে থাকবে তা জানতে আগ্রহ রয়েছে সব প্রযুক্তিপ্রেমীরই। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের আলোচনার ভিত্তিতে তেমনই কিছু প্রযুক্তির কথা তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
পরিধেয় প্রযুক্তি পণ্য
গেল বছরেই পরিধেয় প্রযুক্তি পণ্যের একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ক্রমেই এই বাজার বাড়বে, সেটিও নিশ্চিত বাজার বিশ্লেষকরা। এতদিন পর্যন্ত এসব পরিধেয় প্রযুক্তি পণ্য অবশ্য স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির অ্যাকসেসরিজ হিসেবেই বাজার পেয়ে এসেছে। চলতি বছরে এসে এই ধারা কাটিয়ে পরিধেয় প্রযুক্তি পণ্য নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিতে সমর্থ হবে বলেই মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। স্যামসাং সম্প্রতি ফিটনেস ও ওয়্যারেবল ডিভাইসের জন্য বিশেষায়িত চিপ তৈরির কথা জানিয়ে এই আশাবাদকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। এর মাধ্যমে স্মার্ট হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ফিটনেস ব্যান্ড, ফিটনেস ট্র্যাকার কিংবা ওয়্যারেবল অন্যান্য গ্যাজেট মূলধারার বাজারে প্রবেশের পথ সুগম হয়েছে।
ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি
গেল বছরেই কয়েকটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেটের মাধ্যমে প্রযুক্তি বাজারে সাড়া ফেলেছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি। বেশকিছু গেমিং ডিভাইসের মাধ্যমে অগমেন্টেড রিয়েলিটিও (এআর) এই সময়ের আলোচিত প্রযুক্তি। তবে এখনও পর্যন্ত মূলধারার প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে এই দুই প্রযুক্তি হাজির হতে পারেনি। মূলধারায় এসব প্রযুক্তির প্রবেশের বছর মনে করা হচ্ছে ২০১৬কে। ফেসবুকের কিনে নেওয়া অকুলাস রিফট, এইচটিসি ও ভালভের ভাইভ ভিআর, স্যামসাংয়ের গিয়ার ভিআর কিংবা সনির মরফিয়াস—এরা সবাই চলতি বছরেই মূলধারার বাজারে সাড়া ফেলবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।
স্মার্ট গাড়ি
নানা ধরনের পণ্যের সাথে ইন্টারনেট আর স্মার্ট প্রযুক্তি সংযোজনের ধারাবাহিকতায় গাড়িতেও স্মার্ট প্রযুক্তির দেখা মিলতে শুরু করেছে। গুগল তো স্বচালিত গাড়ি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এর বাইরে অ্যাপল নিয়ে এসেছে তাদের স্মার্ট কার সিস্টেম। টেসলা, জেনারেল মটোরসের মতো সব কোম্পানিরাও নিজেদের গাড়িতে স্মার্ট সিস্টেম যুক্ত করেছে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরকে স্মার্ট গাড়ির জন্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। সম্পূর্ণরূপে স্বচালিত গাড়ি বাজারজাত হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে মনে করা হলেও এই বছরে এসে মূলত এই উদ্যোগ বাস্তবমুখী হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে স্বচালিত স্মার্ট গাড়ি তৈরি করতে গুগল ও ফোর্ডের যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনার কথা জানা গেছে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বছরে এসে এমন গাড়ি নির্মাতা ও প্রযুক্তি কোম্পানির মধ্যে বেশকিছু যুথবদ্ধ প্রচেষ্টা যাত্রা শুরু করবে। ফলে বছরজুড়েই স্মার্ট গাড়ির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রযুক্তি ও উদ্যোগ প্রযুক্তিবিশ্বের আলোচনায় জুড়ে থাকবে, তা বলাই যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বছর
এক হিসেবে গেল বছরকেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বছর বলা যায়। তবে গেল বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্যোগের বেশিরভাগই ছিল গবেষণা বা পরীক্ষামূলক পর্যায়ের। এর মধ্যে বেশকিছু রোবট ছাড়াও অ্যাপল পণ্যে সিরিতে, মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ ১০-এ কর্টানায় বা গুগল সার্চ ইঞ্জিনে দেখা মিলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। এই বছরে এসে এসব প্রযুক্তি তাদের চূড়ান্ত সক্ষমতার নমুনা প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে বলেই মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে মানুষের সাথে কথা বলতে পারা, আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারা কিংবা বিভিন্ন প্রফেশনাল কাজে মানুষের সাথে কাজ করতে পারা রোবটের দেখা তো মিলছেই। চলতি বছরে এসে এমন অনেক রোবটই ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এবারের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক শোতেও (সিইএস) এমন রোবটের উপস্থিতি গত বছরের তুলনায় ৭১ শতাংশ বাড়বে বলেও জানা গেছে। ব্যক্তি পর্যায়েও মানুষের মধ্যে রোবটকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণের ধারাও এ বছর তৈরি হবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।
থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি
সময়ের আরেকটি আলোচিত প্রযুক্তি হলো থ্রিডি প্রিন্টিং। এরই মধ্যে নানা ধরনের পণ্য তৈরির উপযোগী থ্রিডি প্রিন্টারের দেখা মিলেছে প্রযুক্তিবিশ্বে। তবে থ্রিডি প্রিন্টিং এখনও মূলধারার প্রযুক্তি পণ্যে যুক্ত হতে পারেনি। মূলধারার প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে থ্রিডি প্রিন্টারের সংযোজন চলতি বছরেই হবে বলে জানাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। মেকারবট থেকে শুরু করে অন্যান্য থ্রিডি প্রিন্টার নির্মাতারা এরই মধ্যে জানিয়ে রেখেছেন, এ বছরে এসে তারা ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী থ্রিডি প্রিন্টার বাজারে আনবে। এইচপিও চলতি বছরে থ্রিডি প্রিন্টার বাজারে আনবে বলে জানিয়ে রেখেছে। এবারের সিইএসেও গত বছরের তুলনায় থ্রিডি প্রিন্টারের উপস্থিতি বেশি হবে প্রায় ৩১ শতাংশ। এই বছরে এসে তাই থ্রিডি প্রিন্টারকে প্রযুক্তিবিশ্বের আলোচনায় উপস্থিত থাকতে দেখা যাবে প্রায় সময়ই।
ড্রোন
অ্যামাজন, গুগল থেকে শুরু করে অনলাইনে পণ্য বিক্রেতা জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানরা ড্রোনকে আলোচনায় নিয়ে আসেন গত বছরে। ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ সেবার কথায় নড়েচড়ে বসেন অনেকেই। এসব জায়ান্টদের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী অনেক ড্রোনই তৈরি করতে শুরু করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। ড্রোন নিয়ে তাই মানুষদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হলেও ড্রোনের বাজার তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। তবে গেল হলিডে সিজনে ড্রোনের চাহিদা বেশ ভালোই উপলব্ধি করেছে নির্মাতারা। তাতে করে মনে করা হচ্ছে, মূলধারার প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে এ বছরে এসে যুক্ত হবে ড্রোনের নাম। ড্রোনের এই সম্ভাবনাময় বাজারের কথা মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এজেন্সি ড্রোন ব্যবহারের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।
চার্জিং ও ব্যাটারি
স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট পিসির মতো ডিভাইস এখন বিশ্বব্যাপী মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এসব ডিভাইসের ব্যাটারি এবং চার্জিং নিয়ে এখনও পর্যন্ত গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি এসব ডিভাইসের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। গেল বছরে অবশ্য ব্যাটারি ও চার্জিং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার নানা উদ্যোগের খবর নজর কেড়েছে প্রযুক্তিবিশ্বের। তবে এগুলোর সবই ছিল প্রোটোটাইপ পর্যায়ে। এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলো জানিয়ে রেখেছে, চলতি বছরে এসে তাদের অনেক প্রোটোটাইপই বাজারজাত শুরু হবে। সেক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ওয়্যারলেস চার্জিং এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাটারিকে পূর্ণ চার্জ করার বেশকিছু প্রযুক্তি। ক্ষুদ্র আকারেও বেশি ব্যাকআপে সক্ষম কয়েকটি ব্যাটারির দেখাও বাজারে মিলবে এ বছরেই। এসব প্রযুক্তির আবির্ভাব মোবাইল ডিভাইসের চার্জিং দুশ্চিন্তাকে অনেকটাই কমিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
হাইব্রিড ডিভাইস
ল্যাপটপ বা নোটবুক ও ট্যাবলেট পিসি—উভয় রকম ডিভাইস হিসেবেই ব্যবহারযোগ্য হাইব্রিড ডিভাইস এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। ২০১৬ সালে এসে এমন হাইব্রিড ডিভাইসের ব্যবহার আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে ট্যাবলেট পিসির মতো ডিভাইসগুলোকে এখন নির্মাতা ডিজাইন করছেন ল্যাপটপের সক্ষমতায়। আবার ল্যাপটপে তারা যুক্ত করছেন ডেস্কটপ পিসির সক্ষমতা। তাতে করে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইসের পার্থক্য ম্লান হতে শুরু করেছে। সর্বশেষ অ্যাপলের আইপ্যাড প্রো কিংবা গুগলের পিক্সেল সি ট্যাবলেট পিসি ল্যাপটপের সক্ষমতায় কাজ করতে সক্ষম বলে জানিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে মাইক্রোসফট প্রথমবারের মতো নিয়ে এসেছে সারফেস বুক নামের নিজস্ব ল্যাপটপ। একে আবার ট্যাব হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। উইন্ডোজ ১০কেও মাইক্রোসফট ডিজাইন করেছে যেকোনো আকৃতির ডিভাইসের জন্যই। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির বিভেদ মিলিয়ে হাইব্রিড ডিভাইসগুলো তাই চলতি বছরের বাজারে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলবে বলেই মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।