নতুন চ্যালেঞ্জে তুরস্ক
নতুন চ্যালেঞ্জে তুরস্ক
তুরস্কে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভ আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন গত সোমবার। আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহে এটি একটি বিরাট ঘটনা বা দুর্ঘটনা। আর বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ ঘটনার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। রাশিয়ার মতো একটি বৃহৎ শক্তিধর দেশের একজন রাষ্ট্রদূত কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত হওয়ার প্রভাব হতে পারে নানা মাত্রিক। অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডের পর ১৯১৪ সালে বসনিয়ায় আর্চ ডিউক ফার্ডিন্যান্ডের হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করেছেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল।
প্রাথমিকভাবে আলেপ্পোসহ সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার নির্বিচার বোমা হামলা ও বাশার আল আসাদের সরকারকে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখার ভূমিকার কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হত্যাকারী নিজেও তা দাবি করেছেন। তবে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা বা এমন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের আসল উদ্দেশ্যইবা কি তা জানতে সময় লাগবে। তবে গত কয়েক মাসে তুরস্ক বিভিন্ন দিক থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড অবশ্যই তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নিশ্চয়ই রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনাকে সহজভাবে নেবে না রাশিয়া। ইতোমধ্যে রাশিয়ার একটি তদন্তকারী দল তুরস্ক পৌঁছেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান কথা বলেছেন ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে। উভয় দেশ এই হত্যাকাণ্ডকে সন্ত্রাসী হামলা বলে চিহ্নিত করেছেন। রাশিয়ার রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহল থেকে এই হামলার পেছনে ন্যাটোসহ পশ্চিমা দেশগুলোর যোগসাজশের অভিযোগ তোলা হয়েছে। অপর দিকে তুরস্কের পক্ষ থেকে রাশিয়া-তুরস্ক সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে কাউকে পরোয়া না করার যে মানসিকতা দেখাচ্ছে রাশিয়া, সে বিচারে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার কিভাবে দেখাবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া দখল থেকে শুরু করে সর্বশেষ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ- সর্বত্রই পশ্চিমা দেশগুলোকে পাত্তা না দেয়ার নীতি গ্রহণ করে চলেছে রাশিয়া এবং কোনো বাধা ছাড়াই এতে সফল হয়েছে তারা। এমনকি এবারের মার্কিন নির্বাচনেও মস্কো প্রভাব বিস্তার করেছে বলে খবর চাউর হয়েছে। সে বিবেচনায় তুরস্কের ওপর রাশিয়ার পরবর্তী মনোভাব কেমন হবে সেটি অবশ্যই দেখার বিষয়।
গত কয়েক মাস ধরেই একের পর এক অস্থিতিশীলতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে ইউরোপের মুসলিম দেশ তুরস্কের ওপর দিয়ে। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তির দিক থেকে দেশটি শীর্ষে। আর সমগ্র বিশ্বে সামরিক শক্তিতে তুরস্কের অবস্থান অষ্টম। ন্যাটো জোটভুক্ত দেশটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের একে পার্টির সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৩ বছরে তুরস্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করেছে। বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩৫ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে তারা, যা দেশটির শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথাই প্রমাণ করে। গত আগস্টে সুইডেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল বিল্ড তুরস্ক বিষয়ে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এরদোগান ১৩ বছর ধরে বিশ্ব দরবারে প্রবল ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এরদোগান ও তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) প্রথম দশকে এমন কিছু অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কার করেছে, যা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। তুরস্ক ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে, তার সরকারের সংস্কার কর্মসূচি তাকে ওই সদস্যপদ পেতে সহায়তা করেছে। ফলে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার কাছাকাছি চলে গেছে।’
তথাপি দেশ পরিচালনা করতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে। গত ১৫ জুলাই সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। এরদোগানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর জনসাধারণের অসীম সাহসিকতায় সেই অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ না হলে হয়তো মৃত্যু ঘটত আরেকটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার। এ ছাড়া দেশটিতে কুর্দিপন্থী চরমপন্থী সংগঠন পিকেকে একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী আঙ্কারাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে সেনা, পুলিশ কিংবা বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে এই সংগঠনটি। বিচ্ছিন্নতাবাদের ছদ্মবেশে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে সংগঠনটি। অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্র ও পিকেকের সন্ত্রাস, দুটি ইস্যুতেই সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন তুরস্কের কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়া তুর্কি রাজনীতিক ফেতুল্লা গুলেন ছিলেন অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের মূূল হোতা। যুক্তরাষ্ট্র গুলেনকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ তুরস্কের, যদিও যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। পশ্চিমারা কুর্দিদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে এটি বাস্তব। এ বিষয়টি নিয়েও তুরস্কের সাথে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক কিছুটা শীতল গত কয়েক বছর ধরে। আবার তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টিও ঝুলে আছে দীর্ঘ দিন ধরে। কয়েকটি পশ্চিমা দেশের বাধার কারণেই তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারছে না ইউরোপের দেশ হিসেবে। অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের পর জরুরি অবস্থা জারি এবং অভিবাসী স্রোত নিয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে আঙ্কারার তিক্ততা তৈরি হয়েছে। তুরস্ক পশ্চিমাপন্থী দেশ হলেও এরকম কিছু ঘটনায় তাদের সাথে পশ্চিমাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এসব কারণে, কিংবা অন্য যে কারণেই হোক সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী হয়েছে তুরস্ক। বছরখানেক ধরেই দেশ দু’টি পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত আগস্টে এরদোগান মস্কো সফর করে পুতিনের সাথে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। নাগরিকদের ভ্রমণবিষয়ক জটিলতা দূর করতে পুতিনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছেন। সিরিয়া ইস্যুতে দেশ দুটি ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করলেও এর বাইরে মস্কো ও আঙ্কারার সম্পর্ক উষ্ণই বলা যায়। ন্যাটো জোটের সদস্য হয়েও এরদোগান সরকারের এই মস্কোপ্রীতি স্বাভাবিকভাবেই ভালো চোখে দেখছে না ন্যাটো। তাই এরদোগানের সরকারকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খুব একটা আন্তরিকভাবে যে সহযোগিতা করবে না পশ্চিমারা, তা ধরেই নেয়া যায়। নিজের সমস্যা তাই নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে আঙ্কারাকে। উপরন্তু কুর্দিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পশ্চিমাদের অবস্থান তাকে বিপাকে ফেলছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বরাজনীতিতে তুরস্কের ভূমিকা সবসময়ই অগ্রগণ্য ছিল। ইউরোপের প্রবেশদার হিসেবে খ্যাত দেশটি ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মাঝখানে অবস্থিত। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তুরস্ক অন্যতম রুট। আবার মুসলিম বিশ্বেও প্রেসিডেন্ট এরদোগানের রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। যার কারণে সব শক্তিধর দেশই তুরস্কের সাথে সুসম্পর্ক ও দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চায়। দীর্ঘদিন ধরেই সুসম্পর্কের কারণে পশ্চিমারা তুরস্কের কাছ থেকে যে সুবিধা পেয়ে আসছে, একই কারণে অতীত তিক্ততা ভুলে আঙ্কারার সাথে মিত্রতা জোরদার করতে চাইছে। তাই তুরস্ক-রাশিয়ার সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ ছাড়া প্রভাবশালী মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্কের উত্থানও অনেকে মেনে নিতে চাইবে না।
গত দুই দশক ধরে মুসলিম দেশগুলোতে যে ধারাবাহিকভাবে অস্থিরতার ঢেউ উঠেছে তা তুরস্কে আছড়ে পড়তে চাইতেই পারে। একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাতে বিভিন্ন দেশের সরাসরি ইন্ধনের কথা ইতঃপূর্বে মিডিয়ায় এসেছে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার মতো একমাত্র শক্তি তুরস্ক। তাই এই রাষ্ট্রটিকে দুর্বল করে দিতে ভেতর কিংবা বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র ডালপাল ছড়ালে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।