দেশ নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না: প্রধানমন্ত্রী
প্রতিবেদক : স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখা বিদেশি আরও ৫৯ যুদ্ধবন্ধু ও একটি সংগঠনকে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ। সপ্তম পর্যায়ের এ সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। অনুষ্ঠানে যুদ্ধবন্ধু ও তাদের প্রতিনিধির হাতে সম্মাননা তুলে দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ভবিষ্যতে আর কেউ বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্মাননা হিসেবে প্রত্যেককে দেয়া হয় ২২ ভরি রুপার ওপর এক ভরি স্বর্ণ দিয়ে খচিত জাতীয় স্মৃতিসৌধসংবলিত পদক। এবারেও ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ এবং ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ এ দুই ক্যাটাগরিতে সম্মাননা দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬০ জন ‘বিদেশি বন্ধু’ বা তাদের প্রতিনিধিদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক তুলে দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম এবং পদক গ্রহণকারীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মী প্রণব রঞ্জন রায় অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মোশাররফ হোসেন ভূইঞা পদকপ্রাপ্তদের সম্মাননাপত্র পাঠ করেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রীবর্গ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবর্গ, কূটনীতিকবর্গ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস তুলে ধরেন। কৃতজ্ঞতা জানান দেশের জন্য যারা জীবন দিয়ে অবদান রেখেছেন তাদের প্রতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করার লক্ষ্যে তার দৃঢ়অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে এই কাজে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের সহায়তা কামনা করেছেন। তিনি বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের চার দশকের বেশি সময় পরে বিচারের সম্মুখীন করা একটি খুবই কঠিন কাজ। তবে আমরা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ এবং এই কাজ শেষ করার জন্য আমরা আপনাদের সমর্থন চাই। শেখ হাসিনা বলেন, জাতি তার ওপর চাপিয়ে দেয়া অপরাধীদের রেহাই দেয়ার সংস্কৃতির অবসান ঘটানোর একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, এই উদ্যোগ দোষী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে। বিচার প্রক্রিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়আস্থা ব্যক্ত করেন যে, এ বিচার প্রক্রিয়া দেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় বন্ধ করতে সহায়ক হয়েছে। তিনি বলেন, এ প্রক্রিয়া আমাদের নিজ নিজ ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার প্রয়াসে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বছর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়াসে আমরা আপনাদের শুভ কামনা চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার জনগণের সম্ভাবনা ও মেধা কাজে লাগানোর জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আমাদের মা-বোন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তারাই ক্ষমতায় এসেছিল। তারা ক্ষমতায় ছিল ২১ বছর। মানুষ এজন্য অনেক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবার উজ্জীবিত করি। আমাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনে এ সুযোগ দেয়ার জন্য দেশের জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ স্বাধীন দেশ। ভবিষ্যতে কেউ বাংলাদেশের জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। ২০২১ সালের মধ্যে আমারা দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলব। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে কাজ করতে হবে। এর সুফল জনগণের মধ্যে আমরাই ছড়িয়ে দিতে পারব। বিদেশি যেসব বন্ধু আমাদের সহযোগিতা করেছিল তাদের আমারা সম্মানিত করেছি। আমরা একটি কৃতজ্ঞ জাতি। যারা যতটুকু করেছে আমরা যেন তা স্মরণ করি। বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারি। তিনি বলেন, একদিকে ইতিহাস বিকৃত করা হয়, অপরদিকে যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশকে একটি শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। বিশ্বের দরবারে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে থাকবে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে সক্ষম হব।
অনুষ্ঠানের বিস্তারিত: সপ্তম দফায় গতকাল ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফাকরুদ্দিন আলী আহমদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেয়া হয়। তাদের পক্ষে তাদের সন্তান যথাক্রমে ড. পারভেজ আহমদ ও ড. তিজাস নায়েক এ পদক নেন। অন্য ৫৭ ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মাননা’ দেয়া হয়। এর মধ্যে ভারতের ৪৮ জন, পাকিস্তানের ৩ জন, জাপানের ২ জন, মিসরের ১ জন, যুক্তরাজ্যের ২ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ২ জন ও তুরস্কের ১ জন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মোশাররফ হোসেন ভূইয়া সাইটেশন পড়ে শোনান।
এবার সম্মাননা পেয়েছেন ভারতের চিকিত্সক ও রাজনীতিবিদ ডা. জয়নাল আবেদীন, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী স্বপন কুমার ভট্টাচার্য, শিক্ষক ও সমাজকর্মী মৃন্ময়ী বোস, প্রযোজক ও অভিনেতা বিশ্বজিত্ রঞ্জন চ্যাটার্জি, সমাজকর্মী শ্যামল চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রীমতী গৌরী ঘোষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পার্থ ঘোষ, বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার স্বরূপ কৃষ্ণ কউল, মরণোত্তর লেখক ও সমাজকর্মী ড. আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ার, মরণোত্তর সমাজকর্মী স্নেহাংশু কান্তি আচার্য, মরণোত্তর চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোরে, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ ও ইসলামিক চিন্তাবিদ মওলানা সৈয়দ আসাদ মাদানী, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী ভিকে কৃষ্ণ মেনন, মরণোত্তর সংগীতশিল্পী সুচিত্র মিত্র পদ্মশ্রী, মরণোত্তর সমাজকর্মী এনবি মুখার্জি, মরণোত্তর সমাজকর্মী রবীন্দ্র মোহন চৌধুরী, মরণোত্তর রেডক্রসের চিকিত্সক নলীনাক্ষ চৌধুরী, মরণোত্তর আইনজীবী ও সমাজকর্মী আবুল ফজল গোলাম ওসমানী, মরণোত্তর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল (অব.) কুলওয়ান্ট সিং, মরণোত্তর সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখ, মরণোত্তর সাবেক সরকারি কর্মকর্তা অশোক রায়, মরণোত্তর কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মরণোত্তর অর্থনীতিবিদ সমর রঞ্জন সেন, মরণোত্তর কূটনীতিক সমর সেন, ভারতীয় সেনাসদস্য শহীদ সুবেদার মালকিত সিং মহাবীর চক্র, মরণোত্তর সুকদেব সিং সান্ধু এবং মরণোত্তর লে. জেনারেল তপিশ্বর নারায়ণ রায়না মহাবীর চক্র।
পাকিস্তানের মরণোত্তর রাজনীতিবিদ মাস্টার খান গুল, মরণোত্তর রাজনীতিবিদ খান আবদুল ওয়ালী খান এবং মরণোত্তর রাজনীনিতবিদ খান আবদুুল গাফ্ফার খান। জাপানের সমাজকর্মী কেন আরি মিতসু ও মরণোত্তর সেনা কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী লে. জেনারেল লইচি ফুজিওয়ারা। যুক্তরাজ্যের সমাজকর্মী এলিন কনেট ও অধ্যাপক ও সমাজকর্মী ড. পাউয়েল কনেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্মী ম্যারি ফ্রান্সিস ডুনহাম এবং অধ্যাপক ড. আলফ্রেড সোমের। তুরস্কের মরণোত্তর সাংবাদিক ও সমাজকর্মী কেটিন ওজব্যার্ক এবং মিসরের প্রতিষ্ঠান আফ্রো-এশিয়ান পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (এএপিএসও)।
প্রথম পর্যায়ে ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ সম্মাননা বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা দেয়ার মধ্য দিয়ে সম্মাননা দেয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ৭৮ জন ব্যক্তি ও ৬টি সংগঠন মিলে মোট ৮৪টি সম্মাননা দেয় কমিটি। তৃতীয় পর্যায় একই বছরের ২০ অক্টোবর ৬০ ব্যক্তি ও ১টি সংগঠন মিলে মোট ৬১টি, ১৫ ডিসেম্বর চতুর্থ পর্যায়ে ৬০ জন ব্যক্তি ও ২টি সংগঠন মিলে মোট ৬২টি সম্মাননা দেয়া হয়। চলতি বছরের ৪ মার্চ পঞ্চম পর্যায়ে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেয়া হয়। ২৭ মার্চ ষষ্ঠ পর্যায় ৬৮ জন ব্যক্তি এবং ১টি সংগঠন মিলে মোট ৬৯টি পুরস্কার দেয় সম্মাননা কমিটি।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা বাংলাদেশ ফ্রিডম অনার দেয়া হয়েছে শুধু ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। এ ছাড়া এর আগে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা দেয়া হয়েছে ১৩ জনকে। এর মধ্যে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, কিউবার সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ফিদেল কাস্ত্রো, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উলসন, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই. কে. গুজরাল, নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, যুগোস্লাভিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি মার্শাল যোশেফ টিটো প্রমুখ। বাকি ২৬৪ জনকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেয়া হয়।