দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট উপস্থাপন হচ্ছে আজ
বিশাল বাজেট বাড়ছে করের বোঝা
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট উপস্থাপন হচ্ছে আজ। বিশাল এ বাজেটে বাড়ছে করের বোঝাও। প্রস্তাবিত বাজেটের মোট আকার হচ্ছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে করদাতা ও করের হার বাড়ানোসহ বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, এবার রাজস্ব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আজ বেলা ৩টায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় এবং ব্যক্তিগত নবম বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন। এটি দেশের ৪৫তম বাজেট। একাধারে ৭বার বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন। এর আগে এরশাদ সরকারের আমলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটও ঘোষণা করেন তিনি। এবারও ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করা হবে।
এবারের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৩০,৫০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৭,৫০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৯,৫০০ কোটি টাকা। এবারের বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এডিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি, যা বর্তমান মন্দা অর্থনীতির মধ্যে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। যদিও অতীতে কখনও ১৯ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়নি। তাই আগামী অর্থবছরের বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ওপর আলোচনা হবে ৭ই জুন এবং ৮ই জুন এটা পাস হবে। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হবে ৯ই জুন এবং শেষ হবে ২৮শে জুন। ছুটির দিন ছাড়া মোট ১৪ কার্যদিবস এ সাধারণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থাৎ আগামী ৫ই জুন শুক্রবার বিকাল ৪টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব আহরণে করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীও করের আওতা বাড়ানোর পক্ষে। ফলে প্রতি উপজেলায় কর অফিস স্থাপন ও বাড়িওয়ালাদের করের আওতায় আনাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনতে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অফিস স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৬২ উপজেলায় কর অফিস রয়েছে। খুব শিগগির বাকি ৪২৬টি উপজেলাতে কর অফিস স্থাপন করা হবে।
বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ওপর কর দেন; কিন্তু ভাতা করমুক্ত। তাদের ভাতাও করের আওতায় আসতে পারে। এ বিষয়েও প্রস্তাবনা দিয়েছে এনবিআর। এছাড়া ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসরত সামর্থ্যবান করদাতাদের বছরে সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা, জেলা শহরে বসবাসকারীদের ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারীদের ১ হাজার টাকা কর দিতে হয়। করের এ ৩ স্তর ও সর্বনিম্ন করের হার আগামী অর্থবছর থেকে সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকা কর হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
রপ্তানি আয়ের উৎসে কর বৃদ্ধি: তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের উৎসে কর ০.৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ০.৮০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিল এনবিআর। একে আরও বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন যা থাকছে: এবারের বাজেটে অনেকগুলো বিষয় নতুন থাকছে। এর মধ্যে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট তৈরির একটি ঘোষণা থাকবে। তবে সুনির্দিষ্ট কোন কাঠামো থাকবে না। জেলা বাজেটকে আরও সমপ্রসারণ করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা একটি ব্যাংক করার ধারণাও থাকতে পারে বাজেটে। গ্রামের মানুষকে সঞ্চয়ের সুবিধা দিতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যাপারে একটি ঘোষণা আসতে পারে। সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ সঞ্চয় উৎসাহিত করতে সুদের হার শহরের চেয়ে বেশি করা হতে পারে। শেয়ারবাজারের জন্য থাকছে বিশেষ প্রণোদনা। ঋণের সুদের হার কমানোর একটি ঘোষণাও থাকছে বাজেটে। এছাড়া বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের কর অবকাশ সুবিধা দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধার কথা থাকছে।
অন্য যে খাতে কর বাড়ছে: মোবাইল ফোন সেট আমদানিতে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। এবারের বাজেটের পর এ খাতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। চাল, গম, ভুট্টা বীজ, সানফ্লাওয়ার অয়েল, চিনি, ন্যাপথা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, ঝুট, এমএস রড, কম্পিউটার অ্যাক্সেসরিস, মোবাইল সেট, মডেম, রাউটারসহ আরও বেশকিছু পণ্য আমদানিতে অগ্রিম আয়কর বসতে পারে। এর পাশাপাশি সব ধরনের ব্র্যান্ডের বিড়ি-সিগারেটের ওপরও শুল্ক করহার বাড়তে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বড় বাজেট হলেও মাথাপিছু বরাদ্দ খুবই কম। সে হিসাবে বাজেটের আকারকে খুব বেশি বড় বলা যাবে না। তবে চলতি অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকারকে সরকার অতি উচ্চাভিলাষী মাত্রায় নিয়ে গেছে।
করমুক্ত আয়সীমা: ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমানের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। বর্তমানে নারী ও ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকায় উত্তীর্ণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।