থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আরও ১২৩ বাংলাদেশী রশিদের ভয়াল যাত্রা
থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আরও ১২৩ বাংলাদেশী
রশিদের ভয়াল যাত্রা
টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ যাত্রায় উঠেছিলেন বাংলাদেশী মোহাম্মদ রশিদ। ক্ষুধায় কাতর হয়ে পার করেছেন দিনের পর দিন। চরম নির্যাতন আর মৃত্যুর বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছেন ভয়াল ওই যাত্রায়। মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে রশিদের অবর্ণনীয় দুর্দশার বর্ণনা। পরিবারের ভরণপোষণ চালানোর জন্য কাজ খুঁজছিলেন ২৬ বছরের রশিদ। এমন সময় নিতান্ত সামান্য পারিশ্রমিকে ভিনদেশে কাজের প্রস্তাব দেয় এক ব্যক্তি। বড় আশা নিয়ে কষ্টসাধ্য সমুদ্রযাত্রায় নামেন তিনি। তার সঙ্গে নৌকায় আরোহী ছিল আরও ৪০০ পুরুষ। বিদেশের মাটিতে কাজ পাবার আশা ছিল তাদের চোখে। কিন্তু তাদের সেই আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। তাদের কেউ মারা গেছেন সমুদ্রেই। নৌকার আরোহী অনেকের থেকে সৌভাগ্যবান ছিলেন রশিদ। নৌকায় মারা যাওয়াদের মৃতদেহ ছুড়ে ফেলা হয় সমুদ্রে। রশিদ বলেন, নৌকায় করে আমরা সবাই মিয়ানমার সীমান্তে যাই। সেখানে আমাদেরকে অপেক্ষাকৃত বড় একটি নৌযানে তুলে থাইল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আমরা কেদাহ সীমান্ত এলাকায় গিয়ে পৌঁছাই। কেদাহ থেকে বাসে চড়ে কুয়ালালামপুর যান রশিদ। সেখানে সাক্ষাৎ করেন এক বন্ধুর সঙ্গে। ততক্ষণে চরম অসুস্থ আর দুর্বল হয়ে পড়েন রশিদ। তিনি বলেন, আমি এতো দুর্বল ছিলাম যে কাজ করতে পারতাম না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমার দু’মাস সময় লেগে যায়। আমার বন্ধু আমার দেখাশোনা করে। নৌকার বিভীষিকার কথা স্মরণ করে রশিদ জানায়, সেখানে পর্যাপ্ত খাবার, পানি ছিল না। নৌকাটা ছিল সংকীর্ণ আর নোংরা। স্টোরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নাম পাওয়া টেকনাফ থেকে হাজারো বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। প্রতিদিনই ছেড়ে যায় নৌযান। রশিদ জানায়, যাত্রা পথে বার বার আমার কাছে টাকা চাওয়া হয়। আমার এজেন্ট আমাকে মারধর করে। তাকে ১৪ হাজার রিঙ্গিত পরিশোধ না করতে পারলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আর মালয়েশিয়ার উদ্দেশে দুঃসাধ্য এ যাত্রায় পাসপোর্টও সঙ্গে আনেননি রশিদ। অভিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করে স্থানীয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান ক্যারাম-এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক মোহাম্মদ হারুন আল রশিদের মতে বাংলাদেশী রশিদের গল্প নতুন কিছু নয়। এমন ধরনের ঘটনা তারা প্রায়ই শুনে থাকেন। তিনি বলেন, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। নির্যাতন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত। এটা বিরল কোন ঘটনা নয়।
থাই জঙ্গল থেকে ১২৩ বাংলাদেশী উদ্ধার: থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় সোঙ্খলা প্রদেশের একটি জঙ্গল ও খাউকেউ পর্বত থেকে পৃথকভাবে আরও ১২৩ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের ২৬ জন নাগরিককেও উদ্ধার করা হয়। সন্দেহভাজন মানবপাচারকারী একটি চক্রের সদস্যরা তাদের থাইল্যান্ডে নিয়ে যায়। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। পুলিশ কর্মকর্তা সোমকিয়াত ওস্তাফুন জানান, একটি পাহাড়ের ওপর থেকে ওই অভিবাসীদের উদ্ধার করা হয়। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চ্যান-ওচা আঞ্চলিক মানব পাচার সঙ্কট সমাধানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে সোঙ্খলা প্রদেশে পাচারকারীদের একটি শিবিরে গণকবরের সন্ধান পেয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।ওই গণকবর থেকে ৩০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে তাদের থাইল্যান্ডে পাচার করা হয়েছিল বলে আগেই এক বিবৃতিতে জানানো হয়। এদিকে, গতকাল সোঙ্খলা প্রদেশের হাতইয়াই ও রত্তাফাম এলাকার কাছাকাছি খাও কেউ পর্বত থেকে আরও ৩২ বাংলাদেশী অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ব্যাংকক পোস্ট জানিয়েছে, স্থানীয় পুলিশ ও কর্মকর্তারা রত্তাফাম এলাকার একটি জঙ্গলের কাছ থেকে তাদের শনাক্ত করে। এদের সবাই ছিল ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। ৩২ জনের প্রত্যেকেই পুরুষ। তাদেরকে প্রথমে বান খলোঙ স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রত্তাফাম জেলা কার্যালয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এর আগে উদ্ধারকৃত ১১৭ জন অবৈধ অভিবাসী একই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন।
জাতিসংঘের উদ্বেগ: থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একের পর এক অবৈধ অভিবাসীদের গণকবর পাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। শুক্রবার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি প্রতিবেদনে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরার পর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানবপাচারের ঘটনা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ ঘটেছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনিয়মিত সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আশায় ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে যাত্রা করছেন হাজারো মানুষ। অবৈধপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পৌঁছানো ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রায় এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৩০০ ব্যক্তি মারা গেছেন। ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মারা গেছেন মোট ৬২০ জন। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর নির্যা?তনে। অনেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথাও বলেছেন।