ত্রিমুখী বাহাস
ত্রিমুখী বাহাস
এ বিতর্ক পুরনো নয়। তবে ক্ষমতার ভাগীদারদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক নতুন। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়কার ভূমিকা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জে. (অব.) কেএম সফিউল্লাহ এবং দল হিসেবে জাসদ। গতকাল সর্বশেষ এ বিতর্কে শরিক হয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। বস্তুত তিনি শেখ সেলিমের বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। আজিমপুরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ শাখা ছাত্রলীগ আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনা সভায় মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, জাসদ ও ন্যাপসহ যারা বাম রাজনীতি করতেন ৭২ থেকে ৭৫-এ তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। কেন করেছিলেন, তারাই ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তাদের ঔদ্ধত্য এমন পর্যায়ে ছিল যে, একটা সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য যা যা করণীয় তারা তাই করেছিলেন। আর তারাই ওই সময় তৈরি করেছিলেন জাতির পিতাকে হত্যার প্রেক্ষাপট। তিনি বলেন, আজকে আমাদের নেতা শেখ সেলিমের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে সুর মেলানোর যে অভিযোগ করা হচ্ছে- এটার কোন যৌক্তিকতা নেই। যে যেখান থেকে দেখুক না কেন, ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা নিয়ে কেএম সফিউল্লাহ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রথম বাহাসে জড়ান। বাহাসের এক পর্যায়ে শেখ সেলিম বলেন, আর্মি যখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢুকে পড়ে তখন তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহকে ফোন করে বলেন, তোমার আর্মি আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। তুমি ইমিডিয়েট ব্যবস্থা গ্রহণ করো। বাহাসের এ পর্যায়ে সফিউল্লাহ বলেন, না বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করেননি। আমি সকাল সোয়া পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার ভেতর ঘটনাটি জানতে পারি এবং জানার সঙ্গে সঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধুকে রিং করি। শেখ সেলিম বলেন, ওই সময় কেএম সফিউল্লাহ ধানমন্ডি ৩২ আসার কোন চেষ্টা করেনি। কিংবা ধানমন্ডি ৩২ বঙ্গবন্ধুর বাসায় কি ঘটছে তার তদন্ত করার জন্যও পাঁচটা ট্যাংক নিয়েও তিনি আসেননি। এ বিষয়ে কেএম সফিউল্লাহ বলেন, ট্যাংকগুলো মাসে দুইবার নাইট ট্রেনিং করতো। ১৫ই আগস্ট নাইট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। তাই ১৫ই আগস্ট নাইট ট্রেনিংয়ের নাম করে তারা ট্যাংক ব্যবহার করেছিল। যাতে করে কেউ কোন সন্দেহ না করে। প্রতিউত্তরে শেখ সেলিম বলেন, এটা মোটেও সত্য নয়। তিনি সব মিথ্যে কথা বলেছেন। এবিষয়ে কেএম সফিউল্লাহ বলেন, আমি যখন জানতে পেরেছি কেউ আর জীবিত নেই, তখন সেখানে আমার যাওয়ার কোন কারণ ছিল না। মৃতদেহ দেখে আমার কি লাভ হতো? শেখ সেলিম বলেন, ওইদিন সফিউল্লাহ নীরবতা পালন করেছিল এবং তিনি বাসা থেকে বের হননি। মারা যাওয়ার পর তিনি মিটিং করেছিলেন। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে সফিউল্লাহ বলেন, আমি যদি ওইদিন মারা যেতাম তাহলে লাভটা কি হতো? শেখ সেলিম বলেন, শুধু ফারুক-রশিদ নয় এর পেছনে আরও শক্তি ছিল। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তারা ক্ষমতার লোভে এ কাজ করেছে। শেখ সেলিমের এ অভিযোগের ব্যাপারে সফিউল্লাহ বলেন, আই ডোন্ট কেয়ার। আমি তো মনে করবো- খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে শেখ সেলিমের আঁতাত ছিল। না হয় কেন তিনি ১৫ই আগস্ট মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য। এ বিষয়ে শেখ সেলিম, না না আমি মার্কিন দূতাবাসে কেন যাবো? সফিউল্লাহ কি আমাকে যেতে দেখেছিল? তাহলে তো উনিও সেখানে গিয়েছিলেন। কেএম সফিউল্লাহ বলেন, ১৫ই আগস্ট আমার কোন ভুল ছিল না। শেখ সেলিম বলেন, তিনি যদি সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যেতো। এর জবাবে সফিউল্লাহ বলেন, ওই সময় যদি সব আওয়ামী লীগের লোকজন একত্র হয়ে সেনানিবাসের দিকে ধাওয়া করতো তাহলে তাদের ঠেকাতে পারতো কেউ? শেখ সেলিম বলেন, গোটা জাতি তখন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সফিউল্লাহ বলেন, কথা বলা যায়, কিন্তু কাজের কাজ কেউ করেনি।
এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে কেএম সফিউল্লাহ এবং জাসদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, এটা তো কোন সেনা অভ্যুত্থান ছিল না। বিপথগামী সেনা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। যখন তারা অস্ত্র নেয়, তখনই তাদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত ছিল। উনি (কে এম সফিউল্লাহ) এগিয়ে আসলেন না। কিসের জন্য তিনি নীরব ছিলেন? শেখ মনি মারা যাওয়ার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। সফিউল্লাহ এখন মিথ্যাচার করে বেড়াচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু সবার কাছে ফোন করেছেন। কর্নেল শাফায়াত ছুটে এসেছিলেন। আর উনি বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষেছেন। উনি বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। কত বড় বেয়াদব! বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আর্মির ভয়ে বাসা থেকে পালান না, আর তার বানানো আর্মি দেখে উনি পালিয়ে যাবেন! তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরেই সফিউল্লাহ বিপথগামী সৈনিকদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে গেলেন। কেন তিনি আদেশ দিলেন না, যারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে গেছে, তারা আর ঢুকতে পারবে না। এরা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকলে এদের অ্যারেস্ট করা হবে। কিন্তু অ্যারেস্ট করা হলো না। জিয়াউর রহমান ডেপুটি চিফ ছিলেন। তিনিও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। জিয়াউর রহমান, শাফায়াত জামিল, খালেদ মোশাররফ তখন কি করেছিলেন এ প্রশ্নের জবাব একদিন দিতে হবে। এ জন্য একটা তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। দেড়শ’ জন সেনা কর্মকর্তার কাছে কিভাবে দেড় লাখ সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে? তিনি বলেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল। স্বাধীনতা বিরোধীরা কখনও বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারতো না, যদি গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করতো। ১৫ই আগস্ট কর্নেল তাহেরের ভূমিকা সম্পর্কে শেখ সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান, সেদিন তিনিও রেডিও স্টেশনে যান। তিনি জাসদের গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন। একটা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি গণবাহিনী করেছিলেন। যাকে বঙ্গবন্ধু সহানুভূতিশীল হয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান বানালেন তিনিও ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্ষমতার ভাগাভাগিতে তাহেরের কি হয়েছিল তা পরে দেখা গেছে।
পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন ১৫ই আগস্টের পূর্বে জাসদের ভূমিকার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পেছনে জাসদ ও গণবাহিনী দায়ী। শেখ মুজিব হত্যায় ইনুদের ভূমিকা স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় সরকারের মন্ত্রিত্ব থেকে তার পদত্যাগ করা উচিত। আর মন্ত্রিত্বে থাকতে চাইলে ৭২ থেকে ৭৫-এর ঘটনার জন্য ইনু ও তার দলের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এরপর রাতে শেখ সেলিম ও বিএনপি মুখপাত্রের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে জাসদের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, শেখ সেলিম আর বিএনপির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান খান রিপন যখন একই সময়ে একই ভাষায় জাসদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এই অভিন্ন ভাষার যোগসূত্র কি? ওদিকে, জাসদের সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গতকাল এক সমাবেশে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জানবাজি লড়াই চলছে। আমরা সেই লড়াইকে বিজয়ের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছি; মাঝখানে দলবাজি, দখলবাজিদের উৎপাত শুরু হয়েছে।