তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের প্রতিযোগী হচ্ছে মিয়ানমার
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে মিয়ানমারের তৈরি পোশাক খাত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাণিজ্যিক অবরোধ তুলে নেয়ার পর প্রতিবছরই বাড়ছে মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানি। ২০১২ সালে দেশটির মোট পোশাক রপ্তানি ছিল ৯০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু তিনবছর যেতে না যেতেই এ রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই বিলিয়ন বা দুইশ’ কোটি ডলারে। এক হিসাবে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানি চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নানা ঘটনা দুর্ঘটনার কারণে ক্রেতারা এখন বাংলাদেশের কাছাকাছি দেশগুলোতে পোশাকের অর্ডার বাড়িয়ে দিচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় মিয়ানমারের উদ্যোক্তারাও তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে পোশাক সরবরাহ করছে।
বিশ্বের দামি ব্রান্ডগুলো ইতিমধ্যে মিয়ানমারে তাদের অর্ডার দেয়া শুরু করেছে। এইচএন্ডএম ২০১৩ সালে সেখানে তাদের প্রথম অর্ডার দেয়। এখন ১৩টি কারাখানা এইচএন্ডএমএর জন্য পোশাক রপ্তানি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্রান্ড গ্যাপও মিয়ানমারে অফিস খুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানও মিয়ানমারে বড় কারখানা স্থাপন করেছে। সেখান থেকে তারা ওল্ড নেভি এবং বানানা রিপাবলিকের জন্য পোশাক তৈরি করছে। এডিডাস তাদের সাপ্লাই লাইনে মিয়ারমারের নাম যুক্ত করেছে।
এদিকে মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ উঠে যাওয়ার পর ভারতের টেক্সটাইল উদ্যোক্তারা দেশটিতে কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। সরকারের নীতিমালা সহজ করা, কম মজুরি এবং সাগরপথে যাতায়াত সহজ হওয়ার কারণে ভারতীয় উদ্যোক্তারা সেখানে যেতে মরিয়া। ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের এক হাজার ৬২৪ কিলোমিটার স্থলসীমানা থাকার বিষয়টিও সেখানকার ব্যবসায়ীরা বিবেচনায় নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, যোগাযোগ ভাল হলে ব্যবসা সহজ হবে। বিশেষ করে ভারতে উত্পাদিত তুলা দিয়ে উদ্যোক্তারা মিয়ানমারে টেক্সটাইল কারখানা স্থাপনে আগ্রহী। উল্লেখ্য, ভারত মিয়ানমারের চতুর্থ বৃহত্ বাণিজ্য সহযোগী। ভারত এবং মিয়ানমার ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন করেছে। দু’দেশের মধ্যে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিও হয়েছে। ভারতের ব্যাংকগুলোও মিয়ানমারে তাদের ব্যবসা সমপ্রসারণ করছে। সমুদ্রপথে যাতায়াত সহজ হওয়ায় মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা করতে ভারতের ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হয়ে উঠছে। ইয়াংগুন থেকে চেন্নাই সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব মাত্র এক হাজার ১৪৫ নটিক্যাল মাইল। এ পথ পাড়ি দিতে মাত্র পাঁচ দিন সময় লাগে। ভারতীয় উদ্যোক্তরা তৃতীয় দেশ হিসেবে সিংগাপুর থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও তাদের চিন্তায় রেখেছেন।
উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মিয়ানমার প্রতিবছর যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বাংলাদেশ তার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারের পোশাক রপ্তানি ৯০ কোটি মার্কিন ডলার হলেও ২০১৫ সালে তা দুইশ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অপরদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল দুই হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এর পরের অর্থবছরে রপ্তানি সামান্য বেড়ে দুই হাজার ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমার গার্মেন্টস ম্যানুফাকচারার্স এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে তাদের মোট কারখানার সংখ্যা ছিল ২০০টি। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১২০টি। প্রতি সপ্তাহে সেখানে দু’টি নতুন কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। শ্রমিকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। শ্রমিকদের মজুরি কম হওয়ায় সেখানকার কারখানা মালিকরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। বর্তমানে মিয়ানমারের একজন শ্রমিক মাসে ৮০ মার্কিন ডলার (ওভারটাইমসহ) বেতন পান। অবশ্য এ পরিমাণ বেতন পেতে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ওভারটাইম করতে হয়। অষ্ট্রেলিয়া ভিত্তিক এএনজেড ব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে যে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মিয়ানমার হবে পরবর্তী দশকের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। সস্তা শ্রমিকের কারণে চীনের মত বড় অর্থনীতির দেশগুলো মিয়ানমারের দিকে তাদের কারখানা সরিয়ে নেবে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
এদিকে পোশাক শিল্পে মিয়ানমারের উত্থানকে বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএ-এর সাবেক সহ-সভাপতি এবিএম সামছুদ্দিন এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চীনের উদ্যোক্তারা। সস্তা শ্রমিকের কারণে তারা সেখানে প্রতিনিয়ত কারখানা স্থাপন করছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বড় বড় ব্রান্ডগুলো যারা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে তাদের কয়েকটা এখন মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যে ব্রান্ড প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ পিস পোশাক কিনতো তারা এখন ১০ হাজার পিস মিয়ানমারে দিচ্ছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে নির্দিষ্ট স্টাইলের পোশাকে আগে বাংলাদেশের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থাকলেও এখন তা কমে যাচ্ছে কিংবা আগের মতোই আছে।