তুর্কি বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪১
তুর্কি বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪১
তুরস্কের ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে বন্দুক ও আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪১ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জন বিদেশি। আহত হয়েছেন ২৩৯ জন। ট্যাক্সিতে চড়ে বিমানবন্দরে পৌঁছায় তিন হামলাকারী। এরপর মঙ্গলবার রাতে তারা টার্মিনালের প্রবেশপথে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশ পালটা গুলি ছোড়লে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। এ হামলার দায় এখনও স্বীকার করেনি কেউ। আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে এই হামলার। বুধবার তুরস্কে ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক। কর্মকর্তাদের বরাতে এ খবর দিয়েছে বিবিসি।
বিবিসির প্রতিনিধি বলেন, মঙ্গলবারের হামলা দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি বড় সংঘবদ্ধ হামলা। বলা হচ্ছে, আতাতুর্ক বিমানবন্দরকে অনেকদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। টার্মিনালের প্রবেশপথে এক্স-রে স্ক্যানার রয়েছে। কিন্তু গাড়ির জন্য নিরাপত্তা যাচাই প্রক্রিয়া সীমিত। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে অনেক মৃতদেহ বিশেষ কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ভবনের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচ ও লাগেজ। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোগান বলেছেন, জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে একটি টার্নিং পয়েন্ট হওয়া উচিত এ হামলা। তিনি বলেন, ‘আজ ইস্তাম্বুলে যেসব বোমা বিস্ফোরিত হলো, কাল দুনিয়ার যেকোনো শহরের যেকোনো বিমানবন্দরে হতে পারে।’ এই হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া লক্ষণে দেখা যাচ্ছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র হামলার ঘটনাকে ‘জঘন্য’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘তুরস্কের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর।’ জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থমাস দ্য মেজিজিয়েরে এ হামলাকে কাপুরুষোচিত ও নৃশংস বলে আখ্যা দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসও এই ‘নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার’ নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা ওইসব সহিংসদের হৃদয়কে পরিবর্তন করে দিন এবং শান্তির পথে আমাদের যাত্রার সহায় হোন।’
ইস্তাম্বুলের গভর্নর নিশ্চিত করেছেন, ৪১ জন এ হামলায় নিহত হয়েছেন। ২৩৯ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে ১৩ জন বিদেশি বা দ্বৈত নাগরিক। আহতদের মধ্যে ১০৯ জনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২৩ জন তুর্কি, ৫ জন সৌদি আরবীয়, ২ জন ইরাকি ও একজন করে চাইনিজ, তিউনিশিয়ান, জর্ডানিয়ান, উজবেক, ইরানিয়ান ও ইউক্রেনিয়ান। তুরস্কে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি একজন নারীও নিহত হয়েছেন এই হামলায়।
হামলার রিপোর্টে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যত হামলাকারী টার্মিনালের প্রবেশপথে গুলিবর্ষণ শুরু করে, যেখানে এক্স-রে মেশিন বসানো। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পালটা গুলি চালায়। অন্তত দুই জন ভবনের ভেতর ঢুকে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলাও হওয়া কিছু ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ভবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এক ব্যক্তি। তার আশপাশের মানুষ পালাচ্ছে। পুলিশের গুলিতে সে মাটিতে পড়ে যায়। ২০ সেকেন্ড পড়ে থাকার পর আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তিন হামলাকারীই নিহত হয়েছেন। তুরস্কের বার্তা সংস্থা দোগান জানিয়েছে, হামলাকারীদের ময়নাতদন্ত করার পর তারা বিদেশি নাগরিক বলে ধারণা করা হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
বিবিসির নিরাপত্তা প্রতিবেদন ফ্রাঙ্ক গার্ডনার বলেন, এ হামলার দায় তৎক্ষণাৎ তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার না করাটা আশ্চর্যজনক নয়। তুরস্ক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো হামলার দায় আইএস খুব কমই স্বীকার করেছে। তবে তুরস্কের ভেতরেই কোনো সিরিয়ান অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যার দায় বেশ ফলাওভাবে প্রচার করেছে গোষ্ঠীটি। সব লক্ষণ অনুযায়ী আঙুল তাক করা হচ্ছে আইএসের দিকেই। বৃটিশ সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কর্মকর্তারা বলছেন, এটি এক বিশেষ ধরনের হামলা পদ্ধতি। এই প্যাটার্ন প্রথম দেখা যায় ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার সময়।
আইএস তুরস্ককে টার্গেট করছে কারণ দেশটির সরকারকে অনৈসলামিক হিসেবে বিবেচনা করছে গোষ্ঠীটি। পাশাপাশি পশ্চিমা মিত্র ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতাও এর কারণ হতে পারে। এ ছাড়া তুরস্কের ভেতর এ গোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক ছিন্ন করার দিকে তুর্কি কর্তৃপক্ষ মনোযোগ দেয়ায় আইএস এক ধরনের চাপ অনুভব করছে দেশটিতে। আইএস ছাড়াও তুরস্কের আরেক প্রধান শত্রু কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও গত কয়েক বছরে অনেক হামলা ঘটিয়েছে দেশটিতে। তবে তাদের প্রধান হামলার লক্ষ্যবস্তু পুলিশ ও সৈন্যরা। দক্ষিণ আফ্রিকাগামী বিমানে উঠার কথা ছিল পল রুস নামে এক যাত্রীর। তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি এক হামলাকারীকে দেখেছেন। রুসের ভাষ্য, ‘তার (হামলাকারী) পুরো শরীরে ছিল কালো পোশাক। তবে তার মুখে মুখোশ ছিল না। আমরা একটি কাউন্টারের পেছনে আশ্রয় নিই। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে পেয়েছিলাম। খুব দ্রুতই একটানা দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। ততক্ষণে তার গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়।’ রুস আরও বলেন, ‘একপর্যায়ে সে আমাদের দিকে আসতে থাকে। তার জ্যাকেটের ভেতর একটি বন্দুক ছিল। চারপাশে বেশ উদ্বেগের সঙ্গে তাকাচ্ছিল সে। সে দেখছিল কেউ কি তাকে থামাতে আসে কি না। একপর্যায়ে সে লিফটে চলে যায়। আমরা তখন আরও গুলিবর্ষণের শব্দ পাই। এরপর আরেকটি বিস্ফোরণ। তারপর সব শেষ।’
হামলায় দায়ী কে!
দুঃসময়ে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মঙ্গলবার হামলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে তুরস্কের অর্থনীতি যখন টলটলায়মান তখনই নতুন করে এ হামলা হলো। রাশিয়ার একটি বিমান তুরস্কে ভূপাতিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ানদের তুরস্ক সফরে যেতে বারণ করেন। এতে সেখানকার অর্থনীতিতে বড় একটি আঘাত এসেছে। কারণ, বিপুল সংখ্যক রাশিয়ান তুরস্ক সফরে যান প্রতি বছর। এ থেকে পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় হয় সরকারের। কিন্তু পুতিনের ওই সিদ্ধান্তে তা বলা চলে বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন
অনলাইন সিএনএনের এক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উডরো উইলসন সেন্টারের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক হেনরি জে. বার্কলি। এতে তিনি লিখেছেন, প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে সর্বশেষ হামলায় অংশ নিয়েছে কমপক্ষে তিন ঘাতক। তাদের কাছে ছিল স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। তারা হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে নিজেরা আত্মঘাতী হয়। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এটা বলতেই হয় এটা ছিল একটি উচ্চাভিলাষী অভিযান। হামলাকারীদের দুজন খুব সম্ভবত ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস বা আইএস) এবং কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী। আইসিস গত বছরজুড়ে তুরস্কে হামলা বৃদ্ধি করেছে। তার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু আত্মঘাতী বোমা হামলা। আইসিস সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালায় গত বছর অক্টোবরে। ওই সময় আঙ্কারায় চালানো হামলায় কমপক্ষে ১০৩ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন। মঙ্গলবার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইয়িলদিরিম বলেছেন, প্রাথমিকভাবে বলা যায় সর্বশেষ এ হামলায় আইসিস দায়ী। বাকি সন্দেহভাজন দুজন কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী দল কুর্দিশ ফ্রিডম ফলকন (টিএকে)-এর সদস্য। এ গ্রুপটি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর একটি অঙ্গসংগঠন। ২০১৫ সালের শুরুতে শান্তি প্রক্রিয়ার একটি সমঝোতা ভেঙে যাওয়ার পর কুর্দি সরকার তাদের সঙ্গে তিক্ত লড়াইয়ে লিপ্ত। এ ছাড়া টিএকে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে বেশ কিছু হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে তারা সামরিক বাহিনীকেও টার্গেটে পরিণত করে। তবে সবচেয়ে জটিল বিষয় হলো পিকেকে সংশ্লিষ্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিওয়াইডি)-এর সামরিক শাখা পিপলস প্রটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি) সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পিওয়াইজি নিজেদেরকে আইসিসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর একটি একক বাহিনী হিসেবে প্রমাণ করেছে। তারা আইসিসের নিয়ন্ত্রণে থাকা মানবিজ এলাকায় আইসিসের বিরুদ্ধে অভিযানে লিপ্ত। ওয়াইপিজির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে টানাপড়েন আছে। কারণ ওয়াইপিজি হলো পিকেকে সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ। যখন পিকেকে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সঙ্গে একমত হয় তখনই সিরিয়ার পিওয়াইডি ও তুরস্কের পিকেকে’কে আলাদা করে দেখানো হয়। আসল সত্য হলো দু’পক্ষই একই সময়ে সঠিক এবং ভুল। যুক্তরাষ্ট্রের যেমন খুব বেশি প্রয়োজন সিরিয়ার কুর্দিদের, ঠিক তেমনিভাবে পিকেকে’কে অবৈধ করতে শঙ্কায় থাকে তুরস্ক।
দৃশ্যত মঙ্গলবারের ভয়াবহ হামলা আইসিস চালিয়েছে বলেই বেশি মনে হচ্ছে। এরাই মার্চে ব্রাসেলস বিমানবন্দরে একই ধরনের একটি হামলা চালিয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, আইএস মনে করে যে তুরস্ক সরকার ইসলামবিরোধী। আর সে কারণেই তারা তুরস্কে হামলা চালিয়ে আসছে।