তুরাগ তীরে জুমায় লাখো মুসল্লির ঢল

09/01/2016 11:14 amViews: 5
তুরাগ তীরে জুমায় লাখো মুসল্লির ঢল

টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমায় শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা -যুগান্তর
ব্যাপক উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে শুক্রবার বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। এদিন টঙ্গীর তুরাগ তীরে জুমার নামাজে সমবেত হন লাখ লাখ মুসল্লি। বলা হচ্ছে, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জুমার জামাত এটি। দেশের ১৭টি জেলা থেকে সড়কপথ, রেলপথ ও নৌপথে মসুল্লিরা ইজতেমা ময়দানে হাজির হন। বৃহস্পতিবার থেকে আসতে থাকা মুসল্লিদের ঢল শুক্রবারও অব্যাহত থাকে। আসছেন বিদেশী অতিথিরাও। তবে বিদেশী মেহমানদের সঙ্গে যাতে কোনো জঙ্গি দেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য ১০টি দেশের নাগরিকদের ওপর কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে।

ইজতেমা ময়দানে বেলা ১টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় জুমার জামাত। নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের। ইজতেমায় যোগদানকারী মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমাস্থলে হাজির হন। ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে ইজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ১২টার দিকে ইজতেমা মাঠ উপচে আশপাশের খোলা জায়গা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে স্থান না পেয়ে মুসল্লিরা মহাসড়ক ও অলিগলিসহ যে যেখানে পেরেছেন হোগলা পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ বিছিয়ে জুমার নামাজে শরিক হয়েছেন। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নামাজ শেষে একজনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজ আদায় করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।

আজ ইজতেমার দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল রোববার দুপুরের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে। মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ১৫ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। ১৭ জানুয়ারি জোহরের আগে কোনো এক সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার ছয় দিনের আয়োজন।

পাকিস্তানসহ ১০ দেশের নাগরিক নজরদারিতে : গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ব ইজতেমায় পাকিস্তানসহ ১০ দেশের নাগরিককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিদেশী জঙ্গিরা যেন কোনোভাবেই দেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করেছে সরকার। এসব দেশের মুসল্লিদের ইজতেমায় আসার ক্ষেত্রে সেই দেশে থাকা বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে টিআই (তাবলিগ ইজতেমা) ভিসা নিয়ে আসতে হবে। বিমানবন্দরে তাদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া হবে না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কোসহ ১০টি মুসলিম দেশ এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে। এসব দেশে জঙ্গি তৎপরতা থাকায় অন অ্যারাইভাল ভিসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রথম দিনের বয়ান ও মুসল্লির ঢল : বাদ ফজর তাবলিগের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের হজরত মাওলানা আবদুর রহমানের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইজতেমার ১ম পর্ব। তিনি উর্দুতে বয়ান করেন। বয়ানটি বাংলায় ভাষান্তর করেন স্বাগতিক বাংলাদেশের তাবলিগ মুরব্বি মাওলানা আবদুল মতিন। এরপর বাদ জুমা বাংলাদেশের মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম এবং বাদ আসর ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ জোয়াহের বয়ান করেন। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির হজরত মাওলানা মোহাম্মদ সাদ।

ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জিকির-আসকার, ইবাদত-বন্দেগিতে টঙ্গীর তুরাগ তীর এখন এক পবিত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। আয়োজকদের ধারণা, আনুমানিক ৫ লক্ষাধিক মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেছেন।

বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ ও ভারতের তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুজুর্গরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বয়ান পেশ করছেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হচ্ছে।

বয়ানে বলা হয়, ‘পৃথিবীতে ঈমানের মূল্য অনেক বেশি। ঈমানকে মজবুত করতে হলে আমাদের দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে। আমরা যেন আল্লাহপাকের হুকুমমতো সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে।’

গ্যাস সংকট : বিশ্ব ইজতেমার মাঠে বিদেশী অতিথিদের তাঁবুর অস্থায়ী রান্নাঘরে ‘গ্যাসের সরবরাহ কম’ বলে জানা গেছে। ওই তাঁবুতে রান্নার জামাতের জিম্মাদার মো. নুরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকাল থেকে তাদের গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় রান্নায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গত দুদিন তেমন সমস্যা না হলেও আজ (শুক্রবার) বেলা সোয়া ১১টার দিকে হঠাৎ চাপ কমে যায়। ফলে প্রায় ৪০ হাজার বিদেশী মুসল্লির খাবার তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে।’ এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাসের টঙ্গী (বিক্রয়) কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, তারা বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছেন।

ভ্রাম্যমাণ আদালত : গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রাহেনুল ইসলাম জানান, টঙ্গীর ইজতেমাস্থল ও আশপাশের এলাকায় ইজতেমা চলাকালে প্রতিদিন তিন পালায় সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ট্রাফিক কাজে চারটি এবং হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন দোকানে খাবারের মান ও মেয়াদ যাচাইয়ে আরও ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে। গাজীপুরের ১৪ জনসহ বিভিন্ন জেলার ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওইসব আদালত পরিচালনা করছেন। শুক্রবার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার আইনে দু’জনকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।

তিন মুসল্লির মৃত্যু : বিশ্ব ইজতেমায় প্রথম পর্বে অংশ নেয়া মুসল্লিদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতের বিভিন্ন সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তারা মারা যান। তারা হলেন- সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকালি এলাকার জয়নাল আবেদীন (৫৫), কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চকলাপাড় গ্রামের নূরুল ইসলাম (৭২) ও নাটোরের সিংড়া উপজেলার বটিয়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন (৬৫)।

লাশের জিম্মাদার আদম আলী জানান, ইজতেমা ময়দানে জানাজার পর শুক্রবার সকালে মরদেহ নিহতের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

ইজতেমায় বিদেশী অতিথি : গাজীপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, প্রথম দিন আমেরিকা, আরব, ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৯৩টি দেশের ৭ সহস াধিক মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। আগামী দুই দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের জন্য মোট ৫টি তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে।

জেলাভিত্তিক খিত্তা : প্রথম দফায় বিভিন্ন জেলার মুসল্লিদের জন্য পুরো ময়দানকে ২৭টি খিত্তায় (ভাগে) ভাগ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট খিত্তায় নির্দিষ্ট জেলার মুসল্লির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকা জেলার মুসল্লিরা ১ থেকে ৬নং খিত্তায়, শেরপুর ৭নং খিত্তা, নারায়ণগঞ্জ ৮ ও ১১নং খিত্তা, নীলফামারী ৯নং খিত্তা, সিরাজগঞ্জ ১০নং খিত্তা, নাটোর ১২নং খিত্তা, গাইবান্ধা ১৩নং খিত্তা, লক্ষ্মীপুর ১৪ ও ১৫নং খিত্তা, সিলেট ১৬ ও ১৭নং খিত্তা, চট্টগ্রাম ১৮ ও ১৯নং খিত্তা, নড়াইল ২০নং খিত্তা, মাদারীপুর ২১নং খিত্তা, ভোলা ২২ ও ২৩নং খিত্তা, মাগুরা ২৪নং খিত্তা, পটুয়াখালী ২৫নং খিত্তা, ঝালকাঠি ২৬নং খিত্তা এবং পঞ্চগড়ের মুসল্লিরা ২৭নং খিত্তায় অবস্থান নেবেন।

মেডিকেল ক্যাম্প : টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ৪টি মেডিকেল ক্যাম্পে ও টঙ্গী হাসপাতালে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ২ সহস্রাধিক মুসল্লি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ডায়েরিয়াজনিত কারণে ২ জনকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। ৪৪ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান। এছাড়া ইজতেমাস্থলের আশপাশে প্রায় অর্ধশত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে কয়েক হাজার মুসল্লি চিকিৎসা নিচ্ছেন।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বিশ্ব ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের নিরাপত্তায় গাজীপুর জেলা পুলিশ ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। শুক্রবার দুপুরে ইজতেমায় স্থাপিত মিডিয়া সেন্টারে গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের জানান, দেশী-বিদেশী সব মুসল্লির নিরাপত্তায় প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে। এছাড় রাস্তাঘাট, ব্যস্ততম এলাকাসহ পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রেখেছে।

র‌্যাবের প্রেস ব্রিফিং : সকালে এক ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেছেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্ব সম্প্রতি জঙ্গি হামলা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। সবাই জঙ্গি হামলার আশংকা করছে। আমরা সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে এখানে কাজ করছি। জঙ্গি হামলার আশংকা মাথায় রেখেই আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। ইজতেমাস্থল ঘিরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি।

তিনি বলেন, ইজতেমার পুরো এলাকা পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের নয়টি অবজারভেশন পোস্ট রয়েছে। তুরাগ নদীতে স্পিডবোটের মাধ্যমে নৌটহল থাকছে। পাশাপাশি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে টহলের ব্যবস্থা রয়েছে।

৪০ হকার আটক : টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ তালুকদার জানান, ময়দানের আশপাশে বসে পসরা সাজিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রির অভিযোগে ৪০ জন হকারকে আটক করা হয়েছে।

আজ যৌতুকবিহীন বিয়ে : ইসলামিক শরিয়া অনুযায়ী আজ বাদ আসর শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সকাল থেকে ওইসব বিয়ের জন্য বয়ান মঞ্চের কক্ষেই বর-কনের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে।

মহাসড়কে যানজট : বিশ্ব ইজতেমায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার উত্তরা থেকে বোর্ডবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়েছে হাজার হাজার মুসল্লি।

হারানো ও প্রাপ্তি : ইজতেমা মাঠের পশ্চিম দিকে হারানো ও প্রাপ্তি সেন্টার খোলা হয়েছে। ময়দানে কেউ কিছু হারালে ও কিছু পাওয়া গেলে সেখান থেকে সঠিক তথ্য প্রদান করা হচ্ছে।

মোবাইল চার্জ ২০ টাকা : ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের জন্য মোবাইল চার্জের একাধিক দোকান খোলা হয়েছে। সেখানে প্রতি ঘণ্টা ২০ টাকায় চার্জ দেয়া যাচ্ছে। চার্জের দোকান মালিক লাল মিয়া বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার টাকা আয় করেছি।’

পত্রিকার প্রতি পাতা ২ টাকা : শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লি যারা নামাজের জায়নামাজ সঙ্গে আনেননি তারা প্রতি পাতা পত্রিকা ২ টাকা করে কিনে জায়নামাজ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

Leave a Reply