তীব্র তাপপ্রবাহে ফাটল : ঝুঁকিতে জাতীয় সংসদ ভবন
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের পাঁচতলায় মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকের সঙ্গে মূল ভবনের সংযোগস্থলের টাইলস উপরের দিকে উঠে গেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে এমনটা হতে পারে বলে অনেকে বললেও গণপূর্ত বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে, জাতীয় সংসদ ভবন একটি ‘অত্যাধুনিক’ ভবন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে এটিতে ফাটল ধরার কথা নয়। তীব্র তাপমাত্রার কারণেই এ ফাটল দেখা দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন সংসদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই জায়গা দিয়ে মসজিদে যাওয়া-আসার সময় সবাইকে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতেও দেখা গেছে। সংসদ সচিবালয়ের বেশ কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, সকাল ৮টার পর থেকে সারাটি দিন এমনকি রাতের ৯টা-১০টা পর্যন্ত সংসদে কর্মরতদের নিজ নিজ কার্যালয়ে আবস্থান করতে হয়। ভবনে ফাটলের কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে এমন শঙ্কায় তারা স্বস্তিতে কাজও করতে পারছেন না।
এদিকে সংসদ ভবনে ফাটল দেখা দেয়ার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এমপিরাও। আর মাত্র চারদিন পরই (২৪ এপ্রিল) চলমান দশম সংসদের দশম অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। নিয়ম রক্ষার এই অধিবেশনে এমনিতেই এমপিদের উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ খুব একটা থাকে না। এর মধ্যে ভবনে ফাটল ধরায় অধিবেশনে উপস্থিতি কমে আসতে পারে বলেও মনে করছেন তারা। এরই মধ্যে অনেকে এই ফাটলে ঝুঁকি ঠিক কতটুকু তা জানার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে বেশ কয়েক এমপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবকণ্ঠকে জানান, প্রায় ৩৪ বছর আগে তৈরি করা সংসদ ভবনটি বিভিন্ন কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মূল নকশা হাতে না থাকায় নকশাবহির্ভূত অনেক কাজের মাধ্যমে ভবনটির সক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছে।
এছাড়া পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে অনেক আগে থেকেই ভবনটিতে কম্পনের সৃষ্টি হতো। সব মিলিয়ে ঝুঁকি তো বেড়েছেই।
তবে আশার কথা হলো ভবনটির সংস্কারে এরই মধ্যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে ফাটল : ঝুঁকিতে জাতীয় সংসদ ভবনসংস্কার কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমে আসবে বলেও মনে করছেন তারা।
গণপূর্ত বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক জানান, দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দুই সংযোগস্থল প্রসারিত হয়েছে। এর চাপ সামলাতে না পেরে টাইলস উপরে উঠে গেছে। এটা ভূমিকম্পের আগেই হয়েছে। ওই ফ্লোর ঠিক করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, দুয়েক দিনের মধ্যেই এটি সংস্কার কাজ শুরু হবে। এছাড়া সংসদ ভবনের আরো কোনো অংশে এ ধরনের ফাটল আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি পাওয়া যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।
তীব্র দাবদাহেই ভবনটিতে ফাটল ধরেছে বলে মনে করছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি কিছুই জানানো হয়নি। মনে হয় তাপে এমনটি হয়েছে। দ্রুত এটির সংস্কার সম্পন্ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে লুই আই কান গড়েছিলেন জাতীয় সংসদ ভবন। ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম এবং শেষ অধিবেশনে প্রথম সংসদ ভবন ব্যবহƒত হয়। তখন থেকেই আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসেবে এই ভবন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে দীর্ঘ ৩৩ বছরে পুরনো হয়ে উঠেছে এই ভবনের ৯ম তলায় স্থাপন করা সেন্ট্রাল এসি এবং এগুলোর মেকানিক্যাল যন্ত্রাংশ। ফলে প্রতিদিন সেসব মেশিন চালু করলেই মৃদু কম্পন ওঠে ভবনের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম তলা।
এটি নিয়ে দৈনিক মানবকণ্ঠে ‘ভূমিকম্প ছাড়াই প্রতিদিন কাঁপে সংসদ ভবন’ ও ‘ভেঙে পড়তে পারে সংসদ ভবন’ শিরোনামে গত বছর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বিষয়টি সংসদের বাজেট অধিবেশনে আলোচনায় আনেন জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দিন খান বাদল। তিনি অন্যতম এই স্থাপত্য নিদর্শনটির রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে বাজেটে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন। জাতীয় সংসদ ভবনের এমন বেহাল অবস্থা জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনাও।
তিনি এ অবস্থা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেন। পরে একনেক বৈঠকে প্রায় ১০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জাতীয় সংসদের পূর্তকাজ, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক সিস্টেমের উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। আগামী জুন মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।