তিস্তা না হওয়াটা হতাশার খবর
তিস্তা না হওয়াটা হতাশার খবর
কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। বর্ণাঢ্য কূটনৈতিক জীবনে কলকাতায় ডেপুটি হাই-কমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে অবসর জীবনেও কাজ করে চলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফর নিয়ে মানবজমিনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা হয়। শুরুতেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশটির প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ঢাকা সফরকে স্বাগত জানান তিনি। বলেন, রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি আসছেন, তাকে স্বাগত জানাই। তবে এরই মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকা আসতে রাজি হলেও আসন্ন সফরে বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এটা অবশ্যই হতাশার খবর। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই ঘোষণায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। পশ্চিমবঙ্গ এবং মমতা ব্যানার্জির মতামতকে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার যে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আগামী দিনেও দেবে সেটি সুষমা স্বরাজ আরও স্পষ্ট করেছেন। বাংলাদেশের ওই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক মনে করেন গণতন্ত্র, ভিন্ন মত এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। নরেন্দ্র মোদি-মমতা ব্যানার্জির একসঙ্গে ঢাকায় আসার প্রস্তাবে একে অন্যকে যেভাবে সম্মান দেখিয়েছেন, সুষমা যেভাবে মমতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং সংহতি প্রকাশ করেছেন- তা থেকেই শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। তার ভাষায়- কিভাবে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হয় সেটি সেখানে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, সম্পর্ক হয় দুই দেশের জনগণের মধ্যে। সরকার এখানে মাধ্যম। সরকার বদলায় জনগণ থাকে। যে কোন দেশের প্রধান শক্তি হচ্ছে জনগণ। তাই সরকার পরিবর্তন হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থাকে। সেখানে সম্পর্কটা দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। একাত্তর সালে দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরবর্তীতে কিছু সমস্যার কারণে এবং সেই সম্পর্ক শুধু সরকারি বা দলীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ায় দূরত্ব তৈরি হয়। দুই দেশের স্বার্থ সব সময় অভিন্ন হবে তা মনে করার কারণ নেই এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভারত বড় দেশ, তার নিজস্ব স্বার্থ, অভিপ্রায় এবং লক্ষ্য রয়েছে। বাংলাদেশেরও তেমনি রয়েছে। সেখানে প্রতিযোগিতা ও ভিন্নতা যেমন থাকতে পারে, তেমনি সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের সুযোগও অনেক। নিরাপত্তাসহ অনেকগুলো বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব ভারতের উদ্বেগ নিরসনে যথেষ্ট সহযোগিতাও দিয়ে চলেছে। সমপ্রতি ভারতের তরফে বাংলাদেশের সঙ্গে ৪১ বছর ধরে ঝুলে থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তি দেশটির সংসদে পাস হওয়ার বিষয়ে স্মরণ করে দেশীয় ওই কূটনীতিক বলেন, চুক্তি সংক্রান্ত বিলটি দেশটির সংসদে পাস হওয়ায় একটি বড় জটিলতা নিরসন হলো। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্বাসের হওয়া জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বন্ধুত্বের ভাল নিদর্শন নয়- সেটি ভারতকে উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশকে যদি তারা বিশ্বাসভাজন বন্ধু বা অংশীদার ভাবে, তাহলে কাঁটাতারের বেড়ার কী প্রয়োজন? সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমরা যেখানে প্রতিনিয়ত পরস্পরের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট আছি, সেখানে অবশ্যই সম্পর্ককে কাঁটাতারের বাইরে নিতে হবে। ভারতের অনেক জায়গাতেই বাইরের শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এলকে আদভানী বলেছিলেন, বাংলাদেশের কেউ আগ্রহী হলে ভারতে অস্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ পেতে পারে। মোদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারেন। এতে ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা তাহলে আরও ইতিবাচক এবং স্বচ্ছ হবে। ভারত যে আমাদের ইতিবাচক অংশীদার, সেটাও মানুষের কাছে প্রমাণ করা সম্ভব হবে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে খানিকটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে সেটি বিবেচনায় নিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, সেই সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে উভয় দেশেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শক্তিশালী, অংশগ্রহণমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে শক্তিশালীই করবে। তার মতে, যেহেতু দুই প্রতিবেশী দেশের ভাগ্য প্রায় একে অপরের সঙ্গে জড়িত সেহেতু আগামী দিনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোও একই সূত্রে গাঁথা। পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, নীতিগত দিক থেকে বাংলাদেশকে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমরা যদি আমাদের কাজ, বিনিয়োগ, রপ্তানি এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য যদি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চাইতে পারি, তাহলে প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তা হওয়া প্রয়োজন। সেই বিবেচনাতেই আঞ্চলিক যোগাযোগের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এবারেও এব্যাপারে বেশকিছু চুক্তিও প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের সময় সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ভারত তার স্বার্থে সুবিধা চাইবে, এটা অন্যায় নয়। এখানে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ কিভাবে তার স্বার্থ আদায় করে নেবে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় ভারতের উদ্যোগে বাংলাদেশের সহযোগী হওয়া এবং পরবর্তীতে নেপাল-ভুটানকে যুক্ত করে সড়ক-রেল যোগাযোগের যে প্রস্তাব রয়েছে তাকে বাংলাদেশের ইতিবাচক হওয়ার বিষয়ে মতামত দিলেও ওই কূটনীতিক বলেন, মনে রাখতে হবে, আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আমরা তিনটি শক্তিকে উত্থানের মুখে দেখতে পাচ্ছি: চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্মিলিত সংস্থা তথা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। ভারতের সঙ্গে যে কানেকটিভিটির কাজ আমরা করছি, তা হলো প্রথম স্তর। দ্বিতীয় স্তরে যেতে হলে বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে কানেকটিভিটি তৈরি করতে হবে, তৃতীয় স্তরে করতে হবে চীনের সঙ্গে। ভারতের হয়তো এব্যাপারে স্পর্শকাতরতা আছে। আমি মনে করি, ভারতের সঙ্গে যাদের প্রতিযোগিতা আছে তাদের হয়ে নয়, বরং সবার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার সুযোগটা বাংলাদেশের জন্য রাখতে হবে এবং বাংলাদেশেরও যথাযথভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা তুলে ধরতে হবে। ভারত-চীনের প্রতিযোগিতা যেন প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতায় হুমকি না হয় সেটিও বিবেচনায় নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।