ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে শুরু হলো দুর্গাপুজো
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গত কয়েক দিন ধরে চলা নিম্নচাপের রেশ কাটেনি বলে চিন্তিত ছিলেন আয়োজকরা। তবে বৃহস্পতিবার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের অগ্রভাগে সম্পন্ন হয়েছে দেবীর বোধন অনুষ্ঠান। বেশ ভালই কেটেছে দেবীর অধিবাস আমন্ত্রণ। ষষ্ঠী পুজোর মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সূচিত হয়েছে পাঁচ দিনব্যাপী শারদোৎসব দুর্গাপুজো। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি, আর ভক্তকুলের আবহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে। পুজোর মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনোয় ভক্তদের নৃত্য আরতি, আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার পাশাপাশি মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা দেশের পুজোম-পগুলো। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে দুর্গতিনাশিনীর আগমন আনন্দে বিহ্বল বিশ্বের কোটি হিন্দু সম্প্রদায়।
ভক্তদের পুজো গ্রহণের জন্য দুর্গা দেবীর মর্ত্যে আগমনের পর বৃহস্পতিবার ষষ্ঠীতিথিতে ম-পে ম-পে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার অধিষ্ঠান হয়। ষষ্ঠীপুজোর মধ্যদিয়েই মূলত শুরু হলো পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব। মাতৃরূপে কৈশাল ছেড়ে দেবী পিতৃগৃহে এসেছেন দোলায় চড়ে। ষষ্ঠীতিথিতে সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটের মধ্যে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ শুরু হয়। ম-পে ম-পে সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙ্গার জন্য করা হয় বন্দনা পুজো।
এর মাধ্যমে কড়া নিরাপত্তায় দেবীর আগমনে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পর্বের চাঞ্চল্য ও মুখরতার আবহে সারাদেশে প্রায় ২৪ হাজার ম-পে শুরু হয় দুর্গাপুজোর আনুষ্ঠানিকতা। নানা আলোচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পুজো ম-পগুলো। প্রতিটি মন্দির-ম-প সেজেছে আপন সৌন্দর্যে। এবার শারদোৎসব এসেছে একটু ভিন্নআঙ্গিকে। দুর্গোপুজো শেষ হওয়ার একদিন পরই অনুষ্ঠিত হবে মুসলিম সম্প্রদায়ের আরেক বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। দুই বৃহৎ ধর্মীয় উৎসবে মাতোয়ারা এখন বাঙালীরা।
উৎসবের ™ি^তীয় দিনে আজ শুক্রবার মহাসপ্তমী। সকালে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে। এর পর সকাল ৮টা ১৪ মিনিটের মধ্যে নব পত্রিকায় প্রবেশ ও স্থাপন শেষে দেবীর মহাসপ্তমীর বিহিত পুজো অনুষ্ঠিত হবে। পুজো শেষে অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ আরতির আয়োজন থাকবে। এভাবে উৎসব চলবে আগামী ১৪ অক্টোবর সোমবার বিজয়া শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এসেছেন বিশ্ব শান্তির জন্য, তথা সবার মঙ্গলের তরে। কিন্তু অসুরবিনাশিনী জগজ্জননী দেবী দুর্গা বাঙালী গৃহে আসেন অন্যভাবে। কৈলাস ছেড়ে প্রতিবছর তিনি আসেন বাবার বাড়িতে কন্যারূপে। দেবী দুর্গার সঙ্গে প্রতি শরতে মর্ত্যে আসেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। এই চালচিত্রে দেবাদিদেব শিবও বাদ যান না। লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও সরস্বতী জ্ঞানের প্রতীক। কার্তিক হচ্ছেন দেবসেনাপতি, শত্রুনাশকারী। আর গণেশ হচ্ছেন সর্বসিদ্ধিদাতা অর্থাৎ মানুষের কামনা পূরণকারী। বাঙালী হিন্দুরা যে কোন শুভ কাজে ইষ্টনাম হিসেবে দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে থাকেন।
ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তা যে সার্বজনীন, তা শারদীয় দুর্গাপুজো এলে সহজে বুঝা যায়। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও শারদীয় দুর্গাপুজোয় আনন্দের অন্ত নেই। সেখানকার মাইকে মাইকে ভেসে উঠে কীর্তন কিংবা পুরনো দিনের গানের সুর। ‘আজি শঙ্খে মঙ্গলগাঁও জননী এসেছে দ্বারে’ কিংবা ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশভুজা জগজ্জননী মা’ এই আহ্বান যেন আকাশে-বাতাসে। জ্ঞান-কর্ম ও নিদ্রার তিন গুণের আঁধারে দেবী মহামায়াকে বন্দনা করতে ভক্তপ্রাণে যেন আকুতির শেষ নেই। গ্রামের কোথাও পুজো উপলক্ষে চলছে রামায়ণ, অষ্টক, কবি ও যাত্রাগাণ। বিচিত্র পসরা সাজিয়ে বসেছে মেলা। নাড়ু, মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমাসহ নানা জাতের মিষ্টির সমারোহ প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে। যার যতটুকু সাধ্য উৎসবের আনন্দ তার ততখানিই।
বৃহস্পতিবার পুজো ম-পগুলো ঘুরে দেখা গেছে প্রায় একই দৃশ্য। পুজোর সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে আগেই। শেষ তুলির ছোঁয়াও শেষ হয়েছে প্রায় প্রতিটি ম-পে। শিল্পীর নিপুণ তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দুর্গাদেবীসহ প্রতিমাগুলোকে। প্রতিটি ম-প সাজানো হয়েছে মনলোভা সাজে। অনেক ম-পে দেবী দুর্গার আগমন ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। বর্ণিল সাজ ও আলোকসজ্জায় সেজেছে পুজো ম-প ও আশপাশের এলাকা। ছোটবড় প্যান্ডেল, মঞ্চ, রঙ-বেরঙের ব্যানার-ফেস্টুন দিয়েও সাজানো হয়েছে ম-পগুলো। ম-পগুলোর প্রবেশদ্বারে নির্মাণ করা হয়েছে ছোটবড় রঙ-বেরঙের তোরণ।
আনন্দমুখর পরিবেশের পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি ম-পে পুলিশ ও আনসারের পাশাপাশি কোথাও কোথাও নিযুক্ত করা হয় র্যাব সদস্যদের। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ছিল সতর্ক প্রহরা। অনেক ম-পে বসানো হয়েছে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর। তবে এত সব কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছেদ ফেলেনি পুজোর উৎসবমুখরতায়। নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বড় বড় পুজো ম-পগুলো পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
বৃহস্পতিবার থেকে পুজো শুরু হলেও রাজধানীর পুজো ম-পগুলোতে ভক্ত আর দর্শনার্থীদের ভিড় তেমন একটা লক্ষ্য করা যায়নি। আয়োজকরা জানান, আজ মহাসপ্তমী থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকবে। আগামীকাল মহাষ্টমী থেকেই জমে উঠবে উৎসব। ওই দিন থেকেই মূলত মন্দিরে, ম-পে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ঢল নামবে। ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দিরের মূল পুজো ম-পের সামনে তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। মহানগর সার্বজনীন পুজো কমিটির তত্ত্বাবধানে পুজোম-প ও মন্দিরকে সাজানো হয়েছে নতুন রঙ ও সাজে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে তোলা হয়েছে সমগ্র মন্দির ও সংলগ্ন এলাকাকে। দেবীর বোধন শেষে সন্ধ্যায় এখানে অনুষ্ঠিত হয় ভক্তিমূলক সঙ্গীতানুষ্ঠান। আজ শুক্রবার মহানগর সার্বজনীন পুজো কমিটির উদ্যোগে এখানে দুস্থদের মধ্যে নতুন বস্ত্র বিতরণ করা হবে।
প্রথম দিকে পুজো না করার সিদ্ধান্ত নিলেও অবশেষে পুজো হচ্ছে হিন্দু অধ্যুষিত পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে। এ ছাড়া জয়কালী মন্দির রোডের ৫০০ বছরের পুরনো রামসীতা মন্দির, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, সিদ্ধেশ^রী কালীমন্দির, রাজারবাগ বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, শ্রী শ্রী যমুনা মাঈ আশ্রম, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, বনগ্রাম রোড পুজো ম-পসহ সর্বত্র উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা গেছে। বিভিন্ন সংগঠন পৃথক বিবৃতিতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।