টালমাটাল বিশ্ব পুঁজিবাজার
গণভোটে আর্থিক পুনরুদ্ধার (বেইলআউট) কর্মসূচি বাস্তবায়নে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ‘না’ ভোট দিয়েছেন গ্রিসের জনগণ। আর জনগণের এ সিদ্ধান্তে দেশটির শিগগিরই এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এদিকে, গ্রিস সংকটের ধাক্কা ভালোভাবেই লেগেছে বিশ্ব পুঁজিবাজারে। লেনদেন শুরুর পর গতকাল সোমবার জাপানের নিক্কেই সূচক ২ শতাংশ কমে যায়। লন্ডন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্টের পুঁজিবাজারের সূচকও গড়ে ১ শতাংশ করে কমেছে। আবার ডলারের বিপরীতে ইউরোর বিনিময়মূল্য আরেক দফা কমে গেছে। ডলারের বিপরীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ইউরোর বিনিময়মূল্য ১ শতাংশ কমে গেছে।
গ্রিসের এই সংকট এবং ভোটের ফলাফলে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তিন দিন আগে প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছিল, ‘আইএমএফের দুঃখজনক গল্প: গ্রিক ট্র্যাজেডি’। শিরোনামটি সত্যি হয়েই দেখা দিয়েছে আইএমএফের জন্য।
গ্রিসের গণভোটের ফলাফলের ওপর গতকাল সোমবার বিবৃতি দিয়েছেন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টিন ল্যাগার্দে। তিনি বলেছেন, ‘গ্রিসের গণভোটের ফলাফলের ওপর তথ্য সংগ্রহ করেছে আইএমএফ। আমরা খুবই নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি এবং গ্রিসের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো সাহায্য আবেদনে সাড়া দিতে প্রস্তুত আছি।’ গ্রিসের কাছে আইএমএফের মোট পাওনার পরিমাণ ২ হাজার ১৪০ কোটি ইউরো।
গ্রিস সংকটে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপে বাংলাদেশের মূল রপ্তানি বাজার যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের অর্থনীতি এখনো শক্তিশালী। তাই গ্রিস সংকট এখনই ইউরোপের বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না বলেই মনে হয়। প্রথম আলোকে একই কথা বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তবে তিনি মনে করেন, গ্রিস সংকটে ইউরোর বিনিময়মূল্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকলে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতনের বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু গ্রিস সংকট নয়, ইউরোপের নানা কাঠামোগত সমস্যার কারণেই কয়েক মাস ধরে ইউরোর দরপতন ঘটছে। তিনি বলেন, ইউরোজোনে থাকা বা না থাকার চেয়ে সংকট কাটাতে গ্রিসকে কৃচ্ছ্রসাধনের দিকে যেতে হবে।
এদিকে, গ্রিসের সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইউরোপের বন্ড বাজারগুলোতে। বিনিয়োগকারীদের বাড়তি আগ্রহের ফলে জার্মানিতে সরকারি বন্ডের সুদের হার কমে গেছে।
পুঁজিবাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার। এর মধ্যে বার্কলেজ ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, ইতালি ও বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ব্যাংক মন্টে ডে পাশির শেয়ারের দাম কমেছে ৫ শতাংশ। বিভিন্ন ব্যাংক গ্রিসকে ঋণ হিসেবে যে অর্থ দিয়েছে, সেগুলো ‘মন্দ ঋণ’ হওয়ার আশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করায় এ অবস্থা তৈরি হয়।
গণভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর গতকাল পদত্যাগ করেছেন গ্রিসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজে (বেইলআউট) দাতাদের শর্ত না মেনে নেওয়ার পক্ষেই গ্রিসের জনগণ রায় দেওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ব্যক্তিগত ব্লগে দেওয়া এক বিবৃতিতে ভারুফাকিস বলেন, ‘আমার পদত্যাগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি সিপ্রাস দাতাদের সঙ্গে আলোচনায় নতুন পথ খুঁজে পাবেন। আমার প্রতি দাতাদের ক্ষোভ গর্বের সঙ্গে মেনে নিয়েই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।’
নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান ও যোসেফ স্টিগলিজ গ্রিসের জনগণের ‘না’ ভোটকে গোটা ইউরোপের জয় হিসেবে দেখছেন। গ্রিসের নাগরিক হলে ক্রুগম্যান এ গণভোটে ‘না’ ভোট দিতেন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘গ্রিস ইউরোজোনে থাকবে কি থাকবে না, তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো রবিবারের গণভোটে প্রমাণিত হয়েছে, মুদ্রা ব্যবস্থাপনার চেয়ে গণতন্ত্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
গ্রিসের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে গতকাল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে বৈঠকে করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। ধারণা করা হচ্ছে, এ দুই নেতার বৈঠকের মাধ্যমে ইউরোজোনের দেশগুলোর জরুরি বৈঠকের সময় ঠিক হতে পারে।
গ্রিসের জনগণের জবাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ইউরোজোনের অর্থমন্ত্রীদের নেতা জেরোয়েন ডিজেলব্লোয়েম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় গণভোটের ফলাফলকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ ফল গ্রিসের ভবিষ্যতের জন্য খুব দুঃখজনক।’
স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়ার মতো ইইউ দেশগুলোর সরকার একই মনোভাব দেখিয়েছে। আর গণভোটের ফলাফলকে ইউরোজোন থেকে গ্রিসের বেরিয়ে যাওয়ার একটি ধাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে রাশিয়া। গ্রিসের কাছে ইইউসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার পাওনা আছে ৩২ হাজার কোটি ইউরো। এর মধ্যে ইইউর পাওনা ২৪ হাজার কোটি ও জার্মানির ৫ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো।