জয়কে অপহরণের অভিযোগ মার্কিন আদালতে গৃহীত হয়নি
জয়কে অপহরণের অভিযোগ মার্কিন আদালতে গৃহীত হয়নি

প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ চক্রান্তের যে অভিযোগ প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে বিএনপি। গতকাল বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ দাবি করেন। তিনি বলেন, ওই মামলার অভিযোগপত্র, আদালতে জমা দেয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের লিখিত প্রতিবেদন, অভিযুক্ত বা সাক্ষীদের জবানবন্দি, মামলার রায়, এমনকি ঢাকার রমনা থানায় দায়েরকৃত এফআইআর কিংবা পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলার কোথাও সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান কিংবা বিএনপির কোনো নেতার নাম উল্লেখ নেই। আদালতে জমা দেয়া মার্কিন সরকারের রিপোর্টে জয়কে অপহরণ বা দৈহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ আদালতে গৃহীত না হলেও শুধু জয়ের ফেসবুকে দেয়া একটা পোস্টের ওপর ভিত্তি করে ঢাকায় পুলিশ হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে এফআইআর, গোপনে তদন্ত এবং মামলা হয়েছে। পরে বয়োবৃদ্ধ ও ভালো মানুষ বলে সুপরিচিত সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হলো।
মির্জা আলমগীর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে অপহরণ চক্রান্তে এফবিআই কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার মামলার বিচারে আদালতে পেশকৃত মার্কিন সরকারের ডকুমেন্টে ইন্ডিভিজ্যুয়াল ওয়ান বা জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা) সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। ওই বিচারের সূত্র ধরে শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হলেও সেই সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে কেন কথা হচ্ছে না? শেয়ার মার্কেট ও ব্যাংকগুলোর যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে তার বিচারও কেন হচ্ছে না? আমরা বলতে চাই, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র আছে কিনা এটা জানার অধিকার অবশ্যই জনগণের আছে। তাই জনগণ এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত চায়। জনগণ জানতে চায়, সন্দেহজনক এই লেনদেনের ৩০০ মিলিয়ন ডলারের উৎস কী? এ বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক কে? এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য প্রত্যাশা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আশা করি সরকার জনগণের এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেয়ার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।
মির্জা আলমগীর বলেন, আমেরিকান নাগরিক রিজভী আহমেদ সিজারের বিরুদ্ধে সে দেশের আদালতে যে মামলা হয়েছিল তাতে ২০১১ সালে তিনি সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে একজন এফবিআই এজেন্টকে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে এক হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন এবং কিছু নথি পেয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল সরকারি কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়া এবং এফবিআই কর্মকর্তার অপরাধ ছিল ঘুষ নেয়া ও বিনা অনুমতিতে সরকারি দলিল কোনো ব্যক্তিবিশেষকে হস্তান্তর করা। তিনি বলেন, এই মামলা চলাকালে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করা হয়। সেখানে ২০১৩ সালের ৯ই মার্চ সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুকে যে বক্তব্য পোস্ট করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে রিজভী আহমেদ সিজারের দুটি উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়। একটি হলো সজীব ওয়াজেদ জয়ের জীবনযাপন ও দুর্নীতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া এবং অন্যটি তাকে অপহরণ ও দৈহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। বিচার চলাকালে জয়ও নিজেকে ভিকটিম দাবি করে মামলার আসামি সিজার তাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ৪ঠা মার্চ ঘোষিত রায়ে জয়কে অপহরণ ও দৈহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য-উপাত্ত না পেয়ে বিচারক মামলায় অভিযুক্ত সিজারকে এ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। সেই সঙ্গে জয়কে ভিকটিম হিসেবে মানতেও রাজি হননি। মামলার রায়ের ৩, ১০, ১২, ১৪, ১৫ পৃষ্ঠায় লেখা বিচারকের কিছু মন্তব্য উদ্ধৃত করে মির্জা আলমগীর বলেন, রায়ে ইন্ডিভিজুয়াল ওয়ান বলতে এখানে সজীব ওয়াজেদ জয়কে বোঝানো হয়েছে। মামলার রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, সিজার প্রকৃতপক্ষে জয় এবং তার মা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে বিব্রত ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপনের প্রমাণ হিসাবে নির্ভরযোগ্য ডকুমেন্ট সংগ্রহের জন্যই চেষ্টা করেছিল। এতে তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। এর প্রমাণও আদালতের রায়ে লিপিবদ্ধ আছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষ আদালতে জয় ও এফবিআই মেমো সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে ‘সন্দেহজনক অ্যাক্টিভিটি রিপোর্ট-(এসএআর)’ ফাইল করতে হয়। সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ৩০০ মিলিয়ন ডলার নিয়েই এই সন্দেহজনক অ্যাক্টিভিটি রিপোর্ট (এসএআর) এফবিআই মেমোর সঙ্গে জমা ছিল। বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকার দেশের, সরকার হওয়ার কথা জনগণের। সেই জনগণের সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে গুটিকয়েক মানুষকে অন্যায়ভাবে সম্পদের মালিক হতে দেয়ার অধিকার কোনো সরকারের থাকতে পারে না। নির্বিঘ্নে এসব লুটপাট চলতে দেয়ার ফলে আজ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পর্যন্ত চুরি করা হয়েছে। এটা বন্ধ করা না গেলে আমাদের প্রিয় দেশটা ফতুর হয়ে যাবে। মির্জা আলমগীর বলেন, ১৬ই এপ্রিল ভোরে একটি প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক পরিচয়ে সাদা পোশাকের কয়েকজন পুলিশ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক এবং দেশের প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের কোনো কারণ বা ওয়ারেন্ট দেখানো হয়নি। এমনকি বাসায় তার বৃদ্ধা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে কিছুই জানানো হয়নি। পরে ২০১৫ সালের ৩রা আগস্ট পল্টন মডেল থানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক মো. ফজলুর রহমানের দায়ের করা এফআইআরের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মির্জা আলমগীর বলেন, শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয় তার ফেসবুকে লেখেন যে- ‘আজ আমাদের সরকার সাংবাদিক ও বিরোধীদল বিএনপি নেতা শফিক রেহমানকে আমাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। এই অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন বিএনপি নেতার পুত্র, একজন সাবেক এফবিআই এজেন্ট এবং তার বন্ধুর মধ্যে ২ জন এখন জেল খাটছেন। শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ ওই মামলা থেকে প্রত্যক্ষভাবে এসেছে।’ বিএনপি মহাসচিব বলেন, সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই বক্তব্য ভিত্তিহীন প্রমাণিত। কিন্তু প্রতিদিন সরকার প্রধান থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতা ও মন্ত্রীরা তারস্বরে একথাই প্রমাণের চেষ্টা করছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনায় সেখানে বসবাসরত একজন বিএনপি নেতার পুত্র অর্থের বিনিময়ে এফবিআই এজেন্টকে কাজে লাগিয়েছিল এবং সেই অপরাধে তাদের জেল হয়েছে। তারা আরও বলছেন, এই হত্যা পরিকল্পনায় সাংবাদিক শফিক রেহমান ও দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ছাড়াও ঢাকা, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন বিএনপি নেতারা জড়িত। সজীব ওয়াজেদ জয়, তার মা এবং রাজনৈতিক সহকর্মীদের ভিত্তিহীন মিথ্যাচারের জবাব দেয়া প্রয়োজন বলেই আমাদের এ সংবাদ সম্মেলন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ইতিমধ্যে এই বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষটিকে ৫ দিনের রিমান্ড শেষে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এটা অমানবিক বলে আমরা মনে করি। তার বাড়ি থেকে কিছু নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে বলেও মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী জেনেছেন। একই কাল্পনিক অভিযোগে দেশ বিদেশে অবস্থানকৃত বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতাদের সম্পর্কে যথেচ্ছ অভিযোগ করে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিএনপিকে জড়িয়ে কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেন, কাল্পনিক এবং মার্কিন আদালতে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত অভিযোগে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকার ও সরকারি দলের নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে বিএনপি নেতাদের অন্যায়ভাবে বিব্রত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে যে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা স্পষ্ট ভাষায় পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দল। বিএনপি অপহরণ বা হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। বরং বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের আমলেই বিএনপি এবং এর অঙ্গদল ও সহযোগী সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছে, যার কোনো বিচার আজও হয়নি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আজ হোক কাল হোক এসব রাজনৈতিক অপহরণ ও হত্যার বিচার হবেই ইনশাআল্লাহ। আমরা তাই মিথ্যা অভিযোগে আটক সাংবাদিক শফিক রেহমানের মুক্তি ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানোর চক্রান্ত বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ড. ওসমান ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি উপস্থিত ছিলেন।