জুইস সেন্টারের সভাও পণ্ড : তোপের মুখে গাফ্ফার চৌধুরীর গোপন অনুষ্ঠান
জুইস সেন্টারের সভাও পণ্ড : তোপের মুখে গাফ্ফার চৌধুরীর গোপন অনুষ্ঠান
১৩ জুলাই ২০১৫,সোমবার
শনিবার রাত থেকেই গাফ্ফার চৌধুরীর সভাকে ঘিরে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশী মসজিদগুলো থেকে তারাবিহ্ নামাজ শেষে বেরিয়ে বেশীর ভাগ মুসল্লি গাফ্ফার চৌধুরীকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে ১২ জুলাই তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান প্রতিহতের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে সংবাদ সংগ্রহ নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা ছিল বেশ তৎপর। ১২ জুলাই রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে ইফতার পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশী জনবহুল এলাকা জ্যাকসন হাইটস-এর জুইস সেন্টারে এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। এমনিতেই প্রবাসী বাংলাদেশী এবং মুসুল্লীদের তোপের মুখে ছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। এ পরিস্থিতিতে কোন প্রকার ঘোষণা ছাড়াই তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাতিলের ঘোষণা দেয় জুইস সেন্টার কর্তৃপক্ষ। রবিবার বেলা ১২টার পর খবর আসে জুইস সেন্টারে হচ্ছে না বিতর্কিত গাফ্ফার চৌধুরীর নাগরিক সংবর্ধনা। এ নিয়ে নিউইয়র্কের বাংলা চ্যানেলগুলোর টিকারে ব্রেকিং নিউজ চালানো হয়; ‘গাফ্ফার চৌধুরীর জুইস সেন্টারের সভা বাতিল করা হয়েছে।’ অন্যদিকে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে অনেক দূরে সিটির জেএফকে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি ক্রাউন প্লাজা হোটেল’র বল রুমে সংক্ষিপ্ত গোপন সভার আয়োজন করেন। সেখানে বিতর্কিত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। পরে মিডিয়া কর্মীরা সংবাদ পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলে তড়িঘড়ি করে গাফ্ফার চৌধুরী ও আয়োজকরা স্থান ত্যাগ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দাবিদারদের জুইস সেন্টারে সংবর্ধনা সভা করার ওই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আগেই ফুঁসে ওঠে প্রবাসীরা। আলোচনা আর সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে কমিউনিটিতে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে বিষয়টি ঘিরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে গাফ্ফার চৌধুরীকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের পক্ষেও জুইস সেন্টারে গাফ্ফার চৌধুরীর সভাস্থলে সকল ধর্মপ্রাণ প্রবাসী ও মুসলামদের ছুটে আসার আহ্বান জানানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার পর থেকেই জুইস সেন্টারের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও এর সহযোগি সংগঠনের নেতারা। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লুর নেতৃত্বে এতে অংশ নেন প্রবাসী বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। এসময়ে তারা গাফ্ফার চৌধুরীবিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান দেন। এ সময় জিল্লুর রহমান জিল্লু বলেন, আল্লাহ ও ইসলাম ধর্মবিরোধী গাফ্ফার চৌধুরীকে আমরা জ্যামাইকাতে ও ব্রুকলিনেও সভা করতে দেইনি। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ও প্রবাসীদের নিয়ে প্রতিহত করেছি। আজকেও তার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি জুইস সেন্টারে ৮ টায় হওয়ার কথা। আমরা সবাই এখানে অবস্থান করছি। সাহস থাকলে আসুক ধর্মপ্রাণ প্রবাসী ও সাধারণ জনগণ ধর্মবিরোধী আয়োজকদের প্রতিহত করবে ইনশাআল্লাহ। সমাবেশে যোগদানকারী নেতাদের মধ্যে বিএনপি নেতা সামসুল ইসলাম মজনু, হেলাল উদ্দিনসহ এবাদ চৌধুরী, আব্দুল খালেক আকন্দ, জাকির এইচ চৌধুরী, আবু সাঈদ আহমদ, সাদেক আহমেদ, আবুল খায়ের, নূরে আলম, আলতাফ, সেলিম রেজা, সাইদুর রহমান, সৈয়দ এনাম আহমেদ, মার্শাল মুরাদ, আব্দুর রহিম, মোহাম্মদ আলী রেজা, রেজাউল আজাদ ভুইয়া, শহাহীন আহমেদ, জীবন শফিক, সাদেক আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় এলাকায় ব্যাপক পুলিশ প্রহরা ছিল।
গোপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গুটিকয়েক ব্যক্তি
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, রাসুল (স.), ইসলাম ধর্ম, আরবী ভাষা ও হিজাব নিয়ে গাফ্ফার চৌধুরীর মন্তব্যকে ঘিরে পুরো নিউইয়র্ক’সহ দেশে-বিদেশে ইতোমধ্যে চলছে তোলপাড়। গেল ৩ জুলাই জাতিসংঘ বাংলাদেশ স্থায়ী কার্যালয়ে প্রথম ওই বক্তব্য ঘিরে পূর্ব ঘোষিত ৫ জুলাই রোববারের বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যামাইকা ব্রুকলীনের সভা পন্ড হয়ে যাওয়ার পর পত্রিকা, বিজ্ঞাপন ও সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকের মাধ্যমে ফের সভার করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সম্মিলিত নাগরিক শক্তি’র নামের সংগঠন। সংগঠনটি বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে গাফ্ফার চৌধুরীকে সংবর্ধনার অনুষ্ঠান ঘোষণা করে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সম্মিলিত নাগরিক শক্তি’র পক্ষে সীতাংশু গুহ তার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলের ফেসবুকে বার্তা (স্টাটাস) পাঠান গাফ্ফার চৌধুরীকে নিয়ে তারা নিউ ইয়র্কের ‘জন এফ কেনেডি’ বিমান বন্দরের কাছে ক্রাউন প্লাজা হোটেলে অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও ছুটে যান সেখানে। গিয়ে দেখা যায় বেলা ৩ টার পর থেকে ঐ হোটেলের বলরুমে মিলনায়তনে গুটি কয়েকজন মিলে গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্য শুনছেন। এ সময় গণমাধ্যম কর্মীরা ছবি তুলতে গেলে তাদের বাধা দেয়া হয়। দ্রুত ঘটনানস্থল ত্যাগ করে লিফটে নিচে নামিয়ে আনা হয় আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। এ সময় আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম সীতাংশু গুহের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, কেন গাফ্ফার চৌধুরীকে গোপনে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অতি গোপনে ও গুটিকয়েক লোকদের নিয়ে এ বৈঠকের যৌক্তিকতা কি। জবাবে উপস্থিত সাংবাদিকদের সীতাংশু গুহ বলেন, আপনারা জানেন গাফ্ফার চৌধুরী হচ্ছেন একজন লিজেন্ড। ৩ জুলাই তার বক্তব্যকে ঘিরে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশের ভাষা আন্দোলনের কালজয়ী গানের রূপকারকে এ ভাবে অপমান করবে তা আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিবেকবানরা মানতে পারছি না। উনাকে গেল দুটি সভাও করতেও দেয়া হয় নি। তাই আমরা একটি নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করি। এ সময় সাংবাদিকরা বলেন, তবে আপনারা তা তো করতে পারলেন না। এসময় সীতাংশু গুহ বলেন, দেখুন আমরা আজকে জুইস সেন্টারের অনুষ্ঠানটি করতে পারলাম না এটা ঠিক। শুনেছি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির পক্ষে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। কোন প্রকার অপ্রীতিকর পরিস্থিতির যাতে না ঘটে তাই আমরা উনাকে এখানে নিয়ে আসি। অবশেষে উই ডিড ইট (আমরা পেরেছি)। আমাদের জয় হয়েছে।
জুইস সেন্টারের সামনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতিবাদ
পুলিশী অনুমতি নেয়া এবং অগ্রিম বুকিং দিয়েও জুইস সেন্টার কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠান করতে না দেয়ার নেপথ্যে দু‘টো কারণ ছিল। এর একটি হচ্ছে, শুক্রবার থেকেই জুইস সেন্টার কর্তৃপক্ষের কাছে অনুষ্ঠান করতে না দেয়ার জন্য ফোন ও লিখিত আবেদন করে আসছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। এছাড়া গত ৩ জুলাই নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত’ শীর্ষক এক লেকচার সিরিজে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী পাকিস্তান ও ইসরাইল সম্পর্কে একটি ভবিষ্যৎ বানী করেছেন। বলেছেন, আমি বেঁচে থাকবো কি না জানি না, তবে আজকে একটা কথা বলতে পারি আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে দুটো রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে। কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি এ দুটো রাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তান ও ইসরাইল। একটি দেশ দক্ষিণ এশিয়াকে অশান্ত করে রেখেছে, আরেকটি দেশ মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্তির মধ্যে রেখেছে। আমেরিকার পতনের সাথে সাথেই এদের পতন হবে। ওই অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ইসরাইল সম্পর্কিত এ বক্তব্য সম্পর্কে জেনেছেন জুইস সম্প্রদায়। তারাই জুইস সেন্টার পরিচালনা করেন। এ পরিস্থিতিতে তারা গাফ্ফার চৌধুরীকে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি বাতিল করেছেন।
ওদিকে, বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে অনেক দূরে সিটির জেএফকে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি ক্রাউন প্লাজা হোটেলের বল রুমে ওই গোপন সংবর্ধনা সভায় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর হাতে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়। যা পরে ফেসবুকেও আপলোড করা হয়। গাফ্ফার চৌধুরীর হাতে ওই ক্রেস্ট তুলে দেন, প্রবীন সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ। এর আগে তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। অতি গোপনীয় সভায় ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সম্মিলিত নাগরিক শক্তি’র পক্ষে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, ড. নূরুন্নবী, সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান ও নিনি ওয়াহেদ, বেলাল বেগ, ড. জিনাত নবী, সরাফ সরকার, শিতাংশু গুহ, কমান্ডর নুর নবী, সব্রত বিশ্বাস, স্বীকৃতি বড়ুয়া, ফাহিম রেজা নূর, মিথুন আহমেদ এবং মিনহাজ আহমেদ সাম্মু প্রমুখ।
এ দিকে রোববার রাতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্থানীয় গণমাধ্যমে একটি বার্তা পাঠানো হয়। প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে: “কিংবদন্তী সাংবাদিক, একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশে কখনোই কোন তালেবানী পতাকা উড়বে না। এ বিশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি। তিনি বলেন, শত অপপ্রচার ও প্রতিকূলতার মধ্যে আজ এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যেভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তাতে আমি আশাবাদী। বাংলদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির বিজয় নিশ্চিত।” অনুষ্ঠানের শুরুতে অনুষ্ঠানের মডারেটর মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরন্নবী বলেন, আমাদের এই অনুষ্ঠানটি ছিলো জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হুমকিতে জুইস সেন্টার কর্তৃপক্ষ ভেন্যু বাতিল করে দেয়। ফলে কয়েক ঘন্টার নোটিশে আমাদের এ সভার আয়োজন করতে হয়। ড. নূরন্নবী বলেন, মৌলবাদী শক্তি ঘোষণা দিয়েছিলো, তারা কোন অনুষ্ঠান করতে দেবে না। কিন্তু আজ উদীচী ও আমরা দু’টি অনুষ্ঠান করে তার জবাব দিয়েছি।