জামায়াত ক্রিমিনাল সংগঠন ॥ তদন্ত শুরু
০ দোষী সাব্যস্ত হলে নিষিদ্ধ করা হতে পারে
বিকাশ দত্ত ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত শেষে আগামী অক্টোবর-নবেম্বরে চীফ প্রসিকিউটরের কাছে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, আরও করা হচ্ছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীকে ‘অপরাধী সংগঠন’ (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে আখ্যায়িত করার পর তদন্ত সংস্থা এ সংগঠনটির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। অতীত, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা এবং বর্তমান কর্মকা-ের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে আলবদর সৃষ্টি করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ব্যক্তিবিশেষ ছাড়াও সংগঠন হিসেবে তারা অপরাধ করেছে। যেমনটি হয়েছিল নুরেমবার্গ ট্রায়ালে। সেখানে অভিযুক্তদের পাশাপাশি সংগঠনকেও দোষী সাব্যস্ত করে নিষিদ্ধ করা হয়। তদন্ত সংস্থার প্রধান এমএ হান্নান খান এ সব কথা জানিয়েছেন।
তদন্ত সংস্থা ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে। পাশাপাশি আরও কিছু মামলার তদন্ত করে যাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা ২৯টি মামলার মধ্যে দাখিল করেছে ১৬টি। আর তদন্ত চলছে ১৩টি মামলার। দাখিলকৃত ১৬টি মামলার মধ্যে ৯টি মামলার বিচার চলছে। ৬টি মামলার রায় হয়েছে। দুটি মামলার রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছে। আপীল বিভাগ একটি মামলার রায় ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে আরও ১৩টি মামলার ও একটি সংগঠনের (জামায়াতে ইসলামী) বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অবশিষ্ট মামলাগুলো নিষ্পত্তি হওয়ার পর নতুন করে আরও মামলা তদন্ত শুরু করা হবে বলে তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ১৩ আগস্ট একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছর কারাদ-প্রাপ্ত আসামি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে দ-ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করেছে প্রসিকিউশন পক্ষ। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায় অনুসারে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করারও আবেদন জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউশন বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, তদন্ত সংস্থা তদন্ত করছে করুক। আমি ট্রাইব্যুনাল যে ফাইন্ডিংস দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদন করেছি। যদি আপীল বিভাগে এ বিষয় সিদ্ধান্ত দেন, তা হলে হয়ে যাবে। আর যদি তদন্ত সংস্থা তদন্ত করে প্রসিকিউশনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন ওই রিপোর্ট দাখিল করবে। এর পর শুনানি হবে। তিনি আরও বলেন, আপীল বিভাগ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে আর ট্রাইব্যুনালের বিষয় লাগবে না।
১৫ জুলাই গোলাম আযমের বয়স বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির পরিবর্তে ৯০ বছর কারাদ- প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ে জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এ সব বিষয় তদন্তকারী সংস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখছে। তদন্ত সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা পুলিশের এএসপি মতিউর রহমান বলেছেন, আমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যাচ্ছি। জামায়াতের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা এবং বর্তমান কর্মকা-ের বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করছি। তদন্ত করতে সময় লাগবে। যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা আশা করছি বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট জমা দেব। ইতোমধ্যে আমরা জামায়াতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। আরও সংগ্রহ করছি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কয়েকটি রায় এবং হাইকোর্টের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে আখ্যায়িত করার পর এ সংগঠনটির বিপক্ষে প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রসিকিউশন জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে। নিবন্ধন অবৈধ হওয়ার পর দল হিসেবে জামায়াত নির্বাচন করতে পারবে না, এমনকি প্রতীক দাঁড়িপাল্লাও পাবে না। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোটের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ রায় দেন। রায়ে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে যে নিবন্ধন দিয়েছে, তা অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। এর কোন আইনগত ভিত্তি নেই। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী দল হিসেবে সরকার বর্তমান আইনেই করতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী এর আগে কয়েকবার নিষিদ্ধ হয়েছিল। সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়বার এবং ১৯৭২ সালে তৃতীয়বার। জিয়াউর রহমান আসার পর ১৯৭৯ সালের ২৫ মে প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী। এর পর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের শীর্ষ ৬ নেতাকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়। প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেছেন, তদন্ত সংস্থার রিপোট পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাব চার্জ দাখিল করব। তিনি বলেন, অনেক আগে নুরেমবার্গ ট্রায়ালে সংগঠন হিসেবে ৮টি সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে বিচারে ৬টি সংগঠনকে সাজা দেয়া হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আলবদর হলো জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র গ্রুপ। আলবদর গঠিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী মিলিটারিদের কার্যক্রমে সাহায্য করার জন্যে দুটি শাখা গঠন করে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে বলা যেতে পারে, জামায়াতে ইসলামী আলবদর, রাজাকার, আলশামস এবং শান্তি কমিটি গঠন করে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বেসামরিক লোকজন এবং তাদের সম্পদ রক্ষায় কোনক্রমেই কোন ভূমিকা রাখেনি। জামায়াতে ইসলামী দুটি প্যারামিলিটারি ইউনিট গঠন করে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার রাজাকার রিক্রুট করা হয়। জামায়াতে ইসলামী আলবদর দ্বারা সংঘটিত হত্যা ও নির্যাতনের দায় এড়াতে পারে না। যদিও জামায়াত বলত যে, তাদের কর্মকা-গুলো মহান ধর্ম ইসলামের জন্য বলা হলেও একাত্তরের কর্মকা-ে সেটা দেখা যায়নি। রায়ে বলা হয়, মুজাহিদ তৎকালীন ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলবদর বাহিনী তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এ বিষয়গুলো ধরেই তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা তদন্ত করে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একাত্তর সালে তাদের জঘন্য ভূমিকার পরবর্তীতে রগকাটা, মানুষ খুন, বোমাবাজিসহ নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ দ্বারা এ দল পুনরায় তাদের আসল মূর্তি তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে এ সংগঠনকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এ সব একত্রে গ্রহণ করে সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, রাজনৈতিক দলের সজ্ঞা, বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারা এক সঙ্গে বিবেচনা করলে বার বার প্রমাণিত হয় এ সংগঠনটি কোনভাবেই আইনসিদ্ধ রাজনৈতিক দল হতে পারে না। এখন তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। হয়ত তারা কোন একটি পজেটিভ রিপোর্ট প্রদান করবে। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোন দল গঠিত হলে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষ, জš§স্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করলে, রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্যকোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গীকার্য পরিচালনা করলে সংগঠন করার অধিকার থাকবে না।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাস থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মাওলানা মওদুদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা শুরু ভারতীয় উপমহাদেশে। একই বছরের ২৬ আগস্ট ৭৫ প্রতিনিধি নিয়ে লাহোরে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। ওই দিন সম্মেলন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে ১৯৩৮ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ৪ কর্মী নিয়ে ‘দারুল ইসলাম’ নামক সংগঠন যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও ভারত জামায়াতে ইসলামী নামে বিভক্ত হয় জামায়াত। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব সৃষ্টি হয় জামায়াতের। ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ নামক একটি বিতর্কিত বই লিখে ১৯৫৩ সালের ২৮ মার্চ গ্রেফতার হন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী। সামরিক আদালতে তাঁর ফাঁসি হয়। পরে সৌদি বাদশাহর হস্তক্ষেপে ১৯৫৫ সালের ২৯ এপ্রিল মুক্তি দেয়া হয় তাঁকে।
এর আগে প্রসিকিউশন পক্ষের ফরমাল চার্জে উল্লেখ করা হয়, শান্তিপূর্র্ণ সমাধানের পথ বের করার উছিলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে ১৫ মার্চ একদল জেনারেলসহ ঢাকায় এসে কালক্ষেপণ করতে থাকেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এ কালক্ষেপণের পেছনে গোপন উদ্দেশ্য ছিল নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আসা জেনারেল আব্দুল হামিদ, লে. জে. রাও ফরমান আলী, মে. জে. খাদিম হোসেন রাজা ঢাকা সেনানিবাসে গোপন প্রস্তুতির পরিকল্পনায় নিযুক্ত ছিলেন। ১৮ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯ মার্চ ঢাকার জয়দেবপুরে রাজবাড়িতে অবস্থানরত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন হাতিয়ার ছিনিয়ে নেয়ার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হলে বাঙালী সৈনিকরা তা নস্যাৎ করে দেয়। অস্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলে তা অগ্রাহ্য হয়। ঘটে যায় সিপাহি বিদ্রোহ। ২ মার্চ জাতীয় শিপিং কর্পোরেশনে জাহাজ এমভি সোয়াত ৭ হাজার টন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ১৬ নম্বর জেটিতে, আরেকটি জাহাজ ওসেন এন্ডব্যান্স অনুরূপ অস্ত্রশস্ত্রে ৩৬২১টি প্যাকেট নিয়ে ১০ নম্বর জেটিতে ভেড়ে। এ সব জাহাজ থেকে মালামাল খালাসের উদ্যোগের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা সাধারণ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। উর্ধতন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন গ্যারিসনে সন্দেহজনক আসা-যাওয়া শুরু করে।
তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী কর্তৃক তাদের এ দেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টি, পিডিপি ইত্যাদিসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দল, শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী ঘাতক বাহিনী আলবদর, আলশামসের পরাজয় হয়।
মুক্তি সংগ্রামের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথকমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হয়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও ২ লাখ মা বোনের নির্যাতিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল রবিবার বিকেল বেলা ঢাকায় গবর্নর হাউস (বর্তমান গণভবন) পিডিবি প্রধান নুরুল আমিন, মৌলভী ফরিদ আহম্মেদ, খাজা খয়ের উদ্দিন, একেএম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, জমিয়েত উলামায়ে ইসলাম সভাপতি মোহসিন উদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট এটি সাদীসহ ১২ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল দখলকৃত বাংলাদেশের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানের সঙ্গে এক ষড়যন্ত্র বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর নীলনক্সা বাস্তবায়নের জন্য আলোচনা, পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যাপক আকারে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়।
ওই আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে ছিল বিভিন্ন সহযোগী বাহিনী সৃষ্টি এবং বািহনীগুলোর কার্যক্রম নির্ধারণ করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘নাগরিক কমিটি’ নামে একটি ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ গঠন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তীতে যা প্রথমে নাগরিক শান্তি কমিটি এবং পরে শান্তি কমিটি নামে পরিচিত হয়। ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান, নুরুল আমীন, অধ্যাপক গোলাম আযমসহ কয়েক নেতার সঙ্গে আলোচনাকালীন ছবি প্রকাশিত হয় (যা ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিলে দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়েছে)।
গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আবারও ৭০ মিনিটের একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার দাবি জানানো হয়। সাধারণ জনগণ যাদের আসামি দুষ্কৃতকারী আখ্যায়িত করতেন, তাদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে দেশের ‘আদর্শ ও সংহতিতে’ বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। আসামি দখলকৃত বাংলাদেশে সহযোগী বাহিনীর নিযন্ত্রণ কমে আসা এবং নিশ্চিত পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে ফাইনাল সলিউশনের পরিকল্পনা হিসেবে ব্যাপক আকারে ও নির্বিচারে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা নেন, যা ওই বৈঠক থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ দখলদার মুক্ত হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যদের দ্বারা বাস্তবায়িত হয় (যা ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়)।
গোলাম আযম জেনারেল টিক্কা খানের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম এবং অন্যরা নাগরিক কমিটি নামের একটি ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ গঠনের পরিকল্পনা নেন। নাগরিক কমিটি পরবর্তীতে শান্তি কমিটি নামে কুখ্যাত ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনে পরিণত হয়। গোলাম আযম ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল অনেকের সঙ্গে অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে শান্তি কমিটি নামে একটি ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ গঠন করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন এলাকা, ইউনিয়ন এবং মহল্লাপর্যায়েও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ অনুযায়ী এরা কাজ করত। যা ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ছাপা হয়। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, এ সব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। —জনকন্ঠ