চরম ঝুঁকির মধ্যে ক্লাস করছে কোমলমতি শিশুরা, লালমোহনে ১৯০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের ৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত ॥ পাঠদান বিরত রাখার সুপারিশ

30/09/2013 4:32 pmViews: 36

Lalmohan pic-1 copy
মোঃ জসিম জনি, লালমোহন:
ভোলার লালমোহনে ১৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের মধ্যে ৫১টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব ভবনে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ক্লাস করতে হচ্ছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দূর্ঘটনার আশংকায় রয়েছে এসব স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। ভবন ঝুঁিকপূর্ণ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী ঠিকমত বিদ্যালয়ে যাচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। এই বিদ্যালয়গুলোতে ভবনের দরজা জানালা ভাঙ্গা। ফ্লোর, কলাম, বীম খসে খসে পড়ছে এবং কোন কোনটির ছাদের প্লাস্টার খসে ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। এছাড়া ফার্নিচার পর্যন্ত নেই অধিকাংশ ভবনে। সরেজমিন উপজেলা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। লালমোহনের ৯ ইউনিয়নে এমন ৫১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা অফিসারকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ এই ৫১টি ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কিছু কিছু স্থানে বাইরে মক্তব ঘরে বা এবতেদায়ী মাদরাসায় ক্লাস করতে দেখা গেছে। তবে অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করানো হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লালমোহন উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯০টি। অভিযোগ উঠেছে এসব বিদ্যালয় ভবন তৈরি করা হয়েছে নিু মানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ঠিকাদাররা এভাবে হাতিয়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ভবন নির্মাণের পর বছর যেতে না যেতেই বিদ্যালয় ভবনের ছাদের বিম, পিলারে ফাটল ধরে জরাজীর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ বিদ্যালয় ভবনের ছাদের বিমের বেশিরভাগ খসে পড়ছে। এই ভবনগুলো ক্ষুদ্র মেরামতের নামে চলে দফায় দফায় ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাণিজ্য। সামান্য চুনকাম আর ফাটল বন্ধ করে ভবনগুলোকে চাকচিক্য করে তোলা হলেও মাস যেতে না যেতেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। ততক্ষণে ঠিকাদার বিল নিয়ে লাপাত্তা। এরকমই চলে আসছে লালমোহনে। সরেজমিনে দেখা যায় বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস চলার উপযোগী কোন পরিবেশ নেই। বিম, পিলার, ছাদ ও দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ছে। ভেঙ্গে পড়া অংশ দিয়ে পানি ডুকছে ক্লাসে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ক্লাস করতে হয়। বিদ্যালয়গুলোতে টয়লেট থাকলেও তা ব্যবহার অনুপযোগী। নেই শ্রেণীকক্ষে বেঞ্চ টেবিল। প্রায় সকল বিদ্যালয়েই বেঞ্চ ও চেয়ার টেবিল ভাঙ্গা দেখা গেছে। বেঞ্চের অভাবে শিক্ষার্থীদের ফ্লোরে রেকসিন বিছিয়েও ক্লাস করতে দেখা গেছে। এরকমই অবস্থা লালমোহনের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। অথচ কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন নজর দিচ্ছে না। কোমলমতি শিশুদের একদিকে ঝুঁকির মধ্যে অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশে ক্লাস করতে হচ্ছে বিদ্যালয়ে। শিশুদের চিত্ত বিনোদনের তো ব্যবস্থা নেই-ই। এ কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। শিক্ষা জীবনের প্রথম ধাপেই প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে তারা। সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপের দিকে তাকালেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে এলাকার শিশু শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।
এব্যাপারে লালমোহন ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে অবস্থিত হাজি ছলেমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ফারুক জানান, বিদ্যালয়ের ভবনটি এতই জড়াজীর্ণ যে ওই ভবনে ক্লাস করার মতো কোন পরিবেশ নেই। শেষ পর্যন্ত ভবনটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। চেয়ার টেবিলও নেই পর্যাপ্ত। ২০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। আমরা এখন পাশের এক বাড়ির দরজায় এবতেদায়ী মাদরাসায় ক্লাস নিচ্ছি।  মিঝি পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগির মিয়া জানান, স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বাইরে মক্তব ঘরে ক্লাস করছি। বদরপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মাসুমা খানম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন কাম সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ হয় ২০০৬ সালে। ৭ বছরের মাথায় ওই ভবনের প্লাস্টার খসে পড়তে শুরু করে। বিল্ডিংটিও কাঁপে। এ অবস্থায় ওই ভবনে ক্লাস করতে হচ্ছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু তাহের। চরভূতা মানিকগঞ্জ স্কুলের ছাত্র সবুজ জানান, আমরা পড়তে বসলে উপর থেকে গায়ে ভবনের প্ল¬াষ্টার খসে পরে। স্কুল চলার সময় আমরা আতংকিত অবস্থায় থাকি। বর্ষার সময় ছাদ থেকে পানি পরে। এসময় আমরা ক্লাস করতে পারিনা।
ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা স্কুল ভবনগুলো হলো দক্ষিণ ফরাজগঞ্জ প্রাঃ বিদ্যালয়, মধ্য মহেষখালী প্রাঃ বিদ্যালয়, গাইমারা প্রাঃ বিদ্যালয়, পাংগাসিয়া নুরিয়া প্রাঃ বিদ্যালয়, নয়ানী গ্রাম প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. পূর্ব লালমোহন হাজী এ. মোতালেব প্রাঃ বিদ্যালয়, দক্ষিণ মেহেরগঞ্জ প্রাঃ বিদ্যালয়, বালামচর প্রাঃ বিদ্যালয়, হাজী সোলায়মান প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. চর ছকিনা সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর চর ছকিনা সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, ডাওরীহাট সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, প. চরলক্ষ্মী প্রাঃ বিদ্যালয়, মধ্য চর ছকিনা প্রাঃ বিদ্যালয়, লেজ ছকিনা প্রাঃ বিদ্যালয়, মধ্য চরলক্ষ্মী প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. ফাতেমাবাদ প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. পূর্ব চরউমেদ প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. রায়চাঁদ প্রাঃ বিদ্যালয়, রমাগঞ্জ সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, চাঁদপুর প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব ফাতেমাবাদ প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. প. অন্নদা প্রসাদ প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর পূর্ব অন্নদা প্রসাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাছুমা খানম প্রাঃ বিদ্যালয়, চরটিটিয়া আদর্শ প্রাঃ বিদ্যালয়, রুজিনা প্রাঃ বিদ্যালয়, ইসলামিয়া প্রাঃ বিদ্যালয়, ষাটদরুন প্রাঃ বিদ্যালয়, মানিকগঞ্জ প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর হরিগঞ্জ প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. ধলীগৌরনগর প্রাঃ বিদ্যালয়, সাতবাড়িয়া প্রাঃ বিদ্যালয়, চরমোল্লাজী প্রাঃ বিদ্যালয়, পূর্ব চরকালাচাঁদ প্রাঃ বিদ্যালয়, গজারিয়া ভ্যানগার্ড প্রাঃ বিদ্যালয়, চরভূতা মিঝিপাড়া প্রাঃ বিদ্যালয়, পূজাখালী সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. বাউরিয়া প্রাঃ বিদ্যালয়, লালমোহন হাই এটাষ্ট সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, নয়াভাংগনী সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, নেয়ামতপুর সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, কচুয়াখালী সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, দেবীরচর সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, চরটিটিয়া এম. নাজিউর রহমান প্রাঃ বিদ্যালয়, দ. মেহেরগঞ্জ দেওয়ালকান্দি প্রাঃ বিদ্যালয়, পূর্ব চরভূতা সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, চরকালাচাঁদ আয়শা খাতুন প্রাঃ বিদ্যালয়, চরউমেদ আদর্শ প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর পেশকার হাওলা প্রাঃ বিদ্যালয়, উত্তর ধলীগৌরনগর সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়। এব্যাপারে লালমোহন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার যোতীশ চন্দ্র শীল জানান, এলজিইডি থেকে ৫১টি বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা দিলেও এ থেকে ৫টি বিদ্যালয় বাদ পড়েছে। ওই ৫টি মোটামুটি ভালো রয়েছে বলে প্রধান শিক্ষকগণ ও কমিটি আস্বস্থ করেছে। পরবর্তী ৪৬টি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ভবনগুলো নতুন করে নির্মাণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তালিকা দেয়া হয়েছে।
এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব বিদ্যালয় ভবন জরুরিভাবে নতুন করে নির্মাণ না করলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভবনধসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রাণ হারানোর শংকাও রয়েছে।

Leave a Reply