গ্রাহক ভোগান্তির শীর্ষে গ্রামীণফোন
গ্রাহক সেবায় চরম ধস নেমেছে গ্রামীণফোনের। ভয়াবহ গ্রাহক ভোগান্তির কারণে প্রতিদিন শত শত গ্রাহক ছেড়ে দিচ্ছেন গ্রামীণের সংযোগ। শুধু ভোগান্তিই নয়, কল, এসএমএস ও ইন্টারনেটের বিল নিয়েও নানারকম প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রামীণের গ্রাহকরা। এসব কারণে খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিও (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন)। খোদ বিটিআরসির জরিপেই উঠে এসেছে গ্রামীণের গ্রাহক ভোগান্তি ও মানহীন সেবার নানা তথ্য।
এদিকে এ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সবগুলো মোবাইল অপারেটরের ৫৭ লাখ সিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে ৪০ লাখ সিমই ভুয়া, নিবন্ধনহীন ও জাল কাগজপত্র দিয়ে তৈরি করার প্রমাণ পেয়েছে। এনআইডি (ন্যাশনাল আইডেন্টিটি) সূত্রে জানা গেছে, এই ৪০ লাখ ভুয়া ও নিবন্ধনহীন সিমের বেশির ভাগ হল গ্রামীণফোনের। সংস্থাটির সূত্র বলছে, শুধু একটি এনআইডি দিয়েই (১৯৮৪৪৪২৫৮৮৩৬৯৮৭১২) ৬ হাজার ৮৫৮টি সিম নিবন্ধন করার প্রমাণ পেয়েছে তারা। তথ্য অনুযায়ী এর অধিকাংশ সিমই হল দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের। এনআইডি প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মোহাম্মদ সালেহ সাংবাদিকদের জানান, সিমকার্ডের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো থেকে যেসব ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছে, সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে অধিকাংশ তথ্যই এনআইডি সেন্টারের রক্ষিত ডাটার সঙ্গে মিলছে না। টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মূলত এ কারণেই গ্রামীণফোনের সিম ক্রয় করে গ্রাহকরা বেশি ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
সম্প্রতি বিটিআরসি দেশের সবগুলো মোবাইল অপারেটরের ৭টি প্যারামিটার নিয়ে একটি জরিপ চালায়। এগুলো হলো কল সেটআপ সাকসেস রেট, কলড্রপ নিয়ন্ত্রণ, এভারেজ ডাউনলোড স্পিড, ইন্টারনেট লেভেল, এভারেজ অফলোড স্পিড, অপারেশনাল কেপিআই ও এডজ (টু জি ইন্টারনেট) স্পিড। জরিপে দেখা গেছে, কোনোটিতেই গ্রামীণফোন এগিয়ে নেই। বিটিআরসি এ ব্যাপারে অফিসিয়াল কোনো তথ্য দিতে রাজি না হলেও বলেছে, প্রতি মাসেই তারা ৬টি মোবাইল ফোন অপারেটরের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে জরিপ করে থাকে। গত জুলাই মাসের জরিপে গ্রামীণফোন সম্পর্কে তারা উল্লিখিত তথ্য পেয়েছে। এর আগে এক জরিপে দেখা গেছে থ্রিজি স্পিডে সবার পেছনে ছিল গ্রামীণ। জরিপে বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর হিসাবে গ্রাহক ভোগান্তি, কলড্রপ, কল সেটআপ সাকসেস রেট, ডাউনলোড স্পিডসহ কোনো ক্ষেত্রেই গ্রামীণ বিটিআরসির টার্গেট পূরণ করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত দেড় দশকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়েছে টেলিযোগাযোগ সেবা। এ সময়ে সেবা ব্যাপ্তির পাশাপাশি বেড়েছে এর মান নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগও। চলতি বছর এমন দেড় হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়ে বিটিআরসিতে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের অভিযোগই সবচেয়ে বেশি।
বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, অপারেটরদের নিজস্ব গ্রাহক সেবা কেন্দ্র ছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে সেবা ও মূল্য-সংক্রান্ত বিষয়ে নানা অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। এর আগে গত বছরও সেলফোন, ফিক্সড ফোন এবং ওয়াইম্যাক্স অপারেটরদের বিভিন্ন সেবার বিষয়ে গ্রাহকরা ১ হাজারের বেশি অভিযোগ করেন। এর মধ্যে পাঁচশ’র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল গ্রামীণফোনের গ্রাহকদের কাছ থেকেই।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেয়া এসব অভিযোগের বাইরেও গ্রামীণের সেবা নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অপারেটরদের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্স সৈয়দ তালাত কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে বিটিআরসির সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়ে থাকে। তারা প্রত্যেকটি অভিযোগ খতিয়ে দেখার পর সমাধান করে বিটিআরসিকে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত বিটিআরসির পাঠানো সব সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান দেয়া হয়েছে।’
মূলত নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নতা, নিম্নমানের ভয়েস সেবা, কলড্রপ, এসএমএস আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ ও অতিরিক্ত অর্থ কেটে নেয়াসহ অপারেটরদের বেশকিছু সেবার বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের। জমা পড়া অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট অপারেটরকে জানিয়ে তা সমাধানের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আর সমস্যার সমাধান করে অভিযোগকারী গ্রাহকের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও জানিয়ে দেয় অপারেটররা। তবে কোনো অপারেটর এতে ব্যর্থ হলে ওই অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।
বিটিআরসির কাছে গ্রামীণফোনের সেবা নিয়ে ই-মেইলে অভিযোগ করা এক গ্রাহক এইচএম রায় জানান, ইমার্জেন্সি ব্যালান্সসহ বিভিন্ন অফার নিয়ে গ্রাহকদের ভোগান্তিতে ফেলছে গ্রামীণফোন। অনেক ক্ষেত্রে অফার চালু করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই তা বন্ধ করে দেয় তারা। তিনি ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে জালিয়াতির অভিযোগ এনে এ বিষয়ে বিটিআরসির কাছে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। সাধারণ গ্রাহকের পাশাপাশি কর্পোরেট গ্রাহকদেরও সেলফোন অপারেটরদের সেবা ও এর মূল্য নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শাহেদ করিম জানান, কর্পোরেট সংযোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ গ্রাহকদের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এমনকি কর্পোরেট সংযোগ ব্যবহার করার কারণে সাধারণ গ্রাহকরা যেসব অফার পেয়ে থাকেন সেগুলোর সুবিধাও পান না এসব গ্রাহক।
টেলিযোগাযোগ সেবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ও তার সমাধানে নিজেদের ওয়েবসাইটে একটি ই-মেইল ঠিকানা দিয়েছে বিটিআরসি। এর বাইরে সংস্থাটির কার্যালয়ে লিখিতভাবেও অভিযোগ জানাতে পারেন গ্রাহক। আর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গ্রাহক হিসেবেই অপারেটরদের দেয়া বিভিন্ন সেবা পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। সম্প্রতি এজন্য বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এ প্রক্রিয়ায় অভিযোগ জানাতে পারছেন অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক গ্রাহক। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহক এখনও ই-মেইল ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। আর বিটিআরসির কার্যালয়ে লিখিতভাবে এমন অভিযোগ জানানোর সুযোগও নেই তাদের অনেকেরই। এছাড়া সংস্থাটির ওয়েবসাইটের বাইরে এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রচারণাও নেই। এর ফলে অভিযোগ করার এ প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জানেন না সিংহভাগ গ্রাহক।
এদিকে গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তি ও অযাচিত বাণিজ্যিক টেলিযোগাযোগ বন্ধের নির্দেশনার বিধান রেখে ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জাতীয় টেলিযোগাযোগ গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষা নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করে বিটিআরসি। একই বছরের মার্চে খাত সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হয়। এরপর তা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর কথা থাকলেও গত দুই বছরেও খসড়া এ নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, এ খসড়া নীতিমালায় গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় একটি বিশেষ বিভাগ গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিটিআরসির বিভিন্ন বিভাগের সাত কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠন করা হবে সিসিআরইউ। এ বিভাগ গ্রাহকদের বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অপারেটরদের নেয়া ব্যবস্থা যাচাই-বাছাই করবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক অপারেটরকে গ্রাহক স্বার্থ রক্ষায় নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ও তার সমাধানের প্রসঙ্গে বিটিআরসির সচিব সরওয়ার আলম যুগান্তরকে জানান, গ্রাহক সুরক্ষা নীতিমালা তৈরির কাজ করছে বিটিআরসি। এটি চূড়ান্ত হলে সেবা নিয়ে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমবে। বর্তমানে গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগ