গোপীবাগে সিক্স মার্ডার ,ছয় জনকেই খুনের নির্দেশ ছিল তাদের ওপর
ছয়জনকে খুন করার নির্দেশ ছিল আমাদের কাছে। তবে ভণ্ডপীরের আরেক পোলা আবদুল্লাহরে পাই নাই। হের ভাগ্য ভালো। বাঁইচ্যা গেল। ছয় পূরণ করার লাইগ্যাই আরেকজনরে খুন করছি।’ হত্যাকাণ্ড শেষে খুনিরা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে এমনই কথা বলেছিল। পরে তারা বাথরুমে হাত-পা ধুয়ে স্বাভাবিকভাবে বাসা থেকে বের হয়ে যায় বলে দাবি করেছেন মৃত্যুপুরী ৬৪/৬, অভয়দাশ লেনের ‘আয়না’ ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া ‘আধ্যাত্মিক’ ব্যক্তি লুৎফর রহমান ফারুকের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) গোলাম মোস্তফা।
বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা ওই ব্যক্তি আরও দাবি করেছেন, তাকেও খুনিরা হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিয়েছিল। তাকে যে হত্যা করেনি এ জন্য তিনি এখনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ২০-২২ মিনিটের মধ্যেই খুনিরা তাদের হত্যাকাণ্ডের মিশন শেষ করেছে। শনিবার দিবাগত গভীর রাতেই ওয়ারী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন নিহত লুৎফরের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, ধর্মীয় উগ্রপন্থিরাই পরিকল্পনা মাফিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নৃশংসভাবে খুন করার জন্য ভাড়া করেছে পেশাদার খুনিদের। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের খুনের ধরনের সঙ্গে তারা গোপীবাগের ট্র্যাজেডির অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। আর নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা এর নেপথ্যে জড়িত থাকতে পারে। একই সন্দেহ নিহত লুৎফরের পরিবারের সদস্যদের। নিহতের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ বলেন, মুফতি হান্নানের অনুসারীরা ৭-৮ বছর আগে আমার বাবা ও বড় ভাইয়ের ওপর হামলা চালিয়েছিল। এদিকে গতকাল সন্ধ্যায়ই মামলাটির তদন্তকাজ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগ। ডিবির উপকমিশনার (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেন মাতব্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ধর্মীয় উগ্রপন্থিরাই হয় তো এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মিশন সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে তারা বর্তমান সময়কে উপযুক্ত মনে করেছে। তবে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত একই সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে সন্দেহভাজন কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, খুনিরা নির্বিঘ্নে হত্যা মিশন সম্পন্ন করতে কয়েক দফা ওই বাড়িতে ভক্ত হিসেবে গিয়েছে। এ জন্য বাড়িটির দ্বিতীয় তলার সবকটি কক্ষ সম্বন্ধে তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল। নামাজের সময়ই তাদের হত্যার জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয় দুর্বৃত্তরা। গতকাল গোপীবাগের ওই বাড়িতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অগণিত উৎসুক মানুষ ওই বাড়ির সামনে ভিড় করেছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে নিহত কথিত ‘আধ্যাত্দিক ব্যক্তির’ ভক্তকুলও। তবে পুলিশ ওই বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে। দ্বিতীয় তলায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারি থামছে না। লুৎফরের অনুসারী যাত্রাবাড়ীর কাঁচামাল ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান জানান, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে এই ‘পীরের’ মুরিদ। তার লেখা বই পড়েই তিনি আকৃষ্ট হন। তবে তার মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। এদিকে ডিবি সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর ডিবি পুলিশ ১৮ গোপীবাগ ১ম লেনে অভিযান চালিয়ে লুৎফর রহমান ফারুকসহ মোট সাতজনকে গ্রেফতার করেছিল। গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে গত শনিবার মনিরুল ইসলাম ওরফে মনির (২৮) ও শাহীন (২২) খুন হয়েছেন। ওই সময় ডিবি কর্মকর্তারা দাবি করেছিল, নিহত লুৎফর নিজেকে কখনো ইমাম মাহদী, কখনো ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি পরিচয় দিচ্ছিলেন। ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে লুৎফর তখন দাবি করেছিলেন, গত ১৯৯০ সালে গেণ্ডারিয়ায় ইমাম মাহদীর (আ.) সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইমাম মাহদী তাকে তার সেনাপতি হওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছিলেন। নিহত আধ্যাত্মিক নেতার বক্তব্য ছিল, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে দুই ওয়াক্ত নামাজ স্বশরীরে না পড়ে মনে মনে পড়লে চলবে। রোজার সময় দিনে ইচ্ছা মতো খাওয়া যাবে। ‘হিজবুল মাহদী’ নামে নিজের ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারের জন্য তার একটি সংগঠনও ছিল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য ২০০৭ সালে শাহবাগ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর -১৮(০২) ০৭। র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, স্পর্শকাতর এই হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ছায়া তদন্ত করছে র্যাব। অন্য সব সম্ভাব্য কারণের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের দিকেই সন্দেহের তীর তাদের।
আনোয়ার মিস্ত্রি ও দারোয়ান সাইফুলকে খুঁজছে পুলিশ : গত শনিবার সন্ধ্যায় গোপীবাগের ওই বাসায় অন্য ভক্তকুলের সঙ্গে ছিলেন নিহত আধ্যাত্দিক নেতা লুৎফর রহমানের খাদেম মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জুর ভায়রা আনোয়ার মিস্ত্রি। অন্য সবার সঙ্গে আনোয়ারকেও দুর্বৃত্তরা হাত-পা বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিয়েছিল। খুনিরা পালিয়ে যাওয়ার পর পরই ওই বাসা থেকে উধাও হয়ে গেছেন আনোয়ার মিস্ত্রি। তিনি সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। শ্বশুরবাড়ি সিরাজগঞ্জ সদরে। অন্যদিকে, ওই বাড়ির দারোয়ান সাইফুল ইসলামেরও হদিস পাচ্ছে না পুলিশ। নিহত লুৎফরের স্ত্রী জানিয়েছেন, সাইফুলও তাদের বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন। তবে ঘটনার কিছুক্ষণ পর সাইফুল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শনিবার বিকাল ৩টার দিকে তিনি তৃতীয় তলার ভাড়া নিয়ে বাড়ির মালিকের মহাখালীর ডিওএইচএসের বাসায় যান। রাতে তিনি সেখান থেকেই বাসায় ছয়জন খুন হওয়ার কথা জানতে পারেন। সাইফুল বলেন, ফারুককে তিনি ‘পীর’ বলে জানতেন। এ জন্য মাঝেমধ্যেই বাসায় মুরিদরা যাতায়াত করত। বিষয়টি তিনি বাড়ির মালিককেও জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ডিসি জাহাঙ্গীর হোসেন মাতব্বর জানান, আনোয়ারের বিষয়টি কিছুটা রহস্যজনক। একই সঙ্গে সাইফুলকেও খোঁজা হচ্ছে।
যেভাবে ধর্ম প্রচার করতেন আধ্যাত্দিক নেতা লুৎফর : নিহত লুৎফরের অনুসারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন দুই বেলা নামাজ পড়ার জন্য বলতেন লুৎফর। তবে নামাজের সময় তারা কোনো সিজদা করতেন না। কেবল বসে ‘আব্বা আল্লাহ’ জপতে বলা হতো তাদের। এ সময় পীর লুৎফরের চেহারা স্মরণ করতেন ভক্তরা। তবে লুৎফর ইমাম মাহদী (আ.)-কে স্মরণ করতেন। লুৎফরের ভক্তদের মধ্যে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের অনেক লোকজন আছে বলে দাবি করেছেন তারা। ইসলাম ধর্মের চার কালিমাকে পরিবর্তন করে পীর লুৎফর ‘আব্বা আল্লাহ ইমাম মাহদী হুজ্জাতুল্লাহ’ নামের কালিমা পড়ার জন্য তার ভক্তকুলদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার তারা প্রতি বছর ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত রোজা রাখতেন। তবে তাদের নিয়মে রোজা রাখা হয় সকালে ভরপেট খাবার খাওয়া ও সন্ধ্যার পর ইফতার করা। একই সঙ্গে দুপুর বেলা হালকা খাবার খাওয়ার বিধান রেখেছিলেন তিনি। আব্বা মানে পরম আত্দা বা পরম পিতা; যা কেবলমাত্র ঈশ্বরকে ডাকার জন্য ব্যবহার করা হয়।
কে এই লুৎফর? : লুৎফুরের বাবার নাম মৃত হোসেন আলী জোয়ার্দার। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল ভূঞাপুরের চরভরুয়ায়। তিন ভাই চার বোনের মধ্যে নিহত লুৎফর ছিলেন দ্বিতীয়। লুৎফরের ছোট ছেলে আবদুল্লাহ জানান, তার বাবা বগুড়া সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। এরপর ওপেঙ্ গার্মেন্টের মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার ছিলেন। পরে ওরিয়ন গার্মেন্টের অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) ছিলেন। তারপর নিজেই একটি বায়িং হাউস খুলেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে সবকিছু ছেড়ে তার ধর্ম প্রচার শুরু হয়। তিনি দাজ্জালের শিকল, শরিয়তে মাহদীর কথা এবং আদিনুর নামে তিনটি বই লিখেছেন। এ ছাড়া আব্বা আল্লাহ ইমাম মাহদী হুজ্জাতুল্লাহ নামে একটি চিঠি লিখেছেন। যে চিঠি বড় বড় ব্যক্তিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে পাঠাতেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে আমার বাবা নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবি করে আসছিলেন। তিনি প্রচলিত পীরদের মতাদর্শ ও উগ্র মৌলবাদ জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং লেখালেখিও করতেন। ২০০৫ সালে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা বাসায় মুফতি হান্নানের অনুসারীরা আমাদের ওপর হামলা করে। ২০০৭ সালে গেণ্ডারিয়ার বাসা থেকে তার বাবাসহ ১০ ভক্তকে গ্রেফতার করে ডিবি। ৪ মাস ১৯ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল খেটেছেন। ২০০৯ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০১১ সালের নভেম্বর গোপীবাগ ১ম লেনের বাসা থেকে গ্রেফতার হয়ে তিন মাস জেল খেটেছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের জুন মাসে তারা ৬৪/৬, আর কে মিশন রোডের ওই বাসায় ওঠেন।
কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দন মোল্লা জানান, ঢাকার গোপীবাগে কথিত পীরের সঙ্গে জবাই হওয়া কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বড়ধুশিয়া গ্রামের মো. রাসেল ভুইয়ার (২২) বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। ছেলের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক সইতে না পেরে তার মা মমতাজ বেগম বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বড়ধুশিয়া গ্রামের মৃত তফাজ্জল হোসেন ভুইয়ার ছেলে মো. রাসেল ভুইয়া (আপন) ঢাকার বিজিএমইএর ফ্যাশন অব টেকনোলজিতে চার বছর মেয়াদি কোর্সে ভর্তি হন। তিনি উত্তরা হাউস বিল্ডিয়ের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। সেখানে তিনি কথিত পীর লুৎফর রহমানের ভক্ত হয়ে পড়েন। গত ১৩ ডিসেম্বর রাসেল বাড়ি থেকে ঢাকায় যান। গত শনিবার ঢাকার গোপীবাগে পীর সাহেবের বাসায় গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাসেল। নিহত রাসেলের মা মমতাজ বেগম বলেন, শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাসেল বাড়ি থেকে ঢাকা যায়। পড়াশোনায় সে মনোযোগী ছিল। ভালো পড়ালেখার জন্য ছেলেকে ঢাকা পাঠিয়ে আজ ছেলেকে চিরতরে হারালাম। আমার ছেলেকে যারা মেরেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।
গ্রামের বাড়িতে দাফন করতে দেবে না এলাকাবাসী
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, খুন হওয়া ৬ জনের মধ্যে কথিত পীর লুৎফর রহমান ও তার বড় ছেলে সরোয়ারুল ইসলাম ফারুকের নিজ বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অজূর্না ইউনিয়নের চরভড়ুয়ায় গ্রামে চলছে শোকের মাতম। এলাকাবাসীর বাঁধার কারনে স্থানীয় ভড়ুয়া কবরস্থানেও তার লাশ দাফন করা সম্ভব হচ্ছে না। রোববার বিকালে সরেজমিনে উপজেলার চরভড়ুয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কথিত পীর লুৎফর রহমান ও তার ছেলে খুন হওয়ার ঘটনায় নিকট আত্মীয়স্বজনের মধ্যে শোকের মাতম চললেও এলাকাবাসী অনেকটা নির্বিকার। তাদের মধ্যে খুনের ঘটনা নিয়ে কোন আগ্রহ বা আলোচনা সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। লুৎফর রহমান ও তার ছেলের দাফন স্থানীয় ভড়ুয়া কবরস্থানে করতে চাইলেও এলাকাবাসীর বাঁধার কারনে তা সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই বাড়ীর লোকজন নিজ বাড়িতেই তিনটি কবর খুড়েছেন তাদের লাশ দাফন করার জন্য। মজিবুর রহমান নামে মুরিদের ঠিকানা না পাওয়ায় তৃতীয় কবরটি খোড়া হয়েছে তার জন্য। ইউপি সদস্য ফজলুল হক, গ্রাম্য মাতাব্বর কালু মিয়া, ভড়ুয়া এলাকার দোকানী জাহিদুল ইসলামসহ স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ভন্ড পীর লুৎফরের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের কারনে কয়েক বছর আগে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল এই গ্রাম থেকে। এলাকার মানুষ তার উপর খুবই মনক্ষুন্ন ছিল। আর একারনেই তাকে ও তার ছেলেকে কবরস্থানে দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
লুৎফর রহমান নিজেকে ইমাম মাহদীর সেনাপতি দাবীর বিষয়টি তার বড় ভাই ফরমান আলী জোয়াদ্দার নিশ্চিত করেছেন।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের চরাঞ্চল অজূর্না ইউনিয়নের চরভরুয়া গ্রামের মৃত হোসেন জোয়াদ্দারের ছেলে লুৎফর রহমান। ছোট বেলা থেকেই ইসলাম ধর্মের বিপরীত ছিলেন। যদিও তার বাবা এলাকার একজন সাধারন মানুষ ছিলেন। লুৎফর রহমান জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ীর পিকনা হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও একই এলাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৯৪-৯৫ ইং সালের দিকে তিনি নিজেকে পীর দাবী করেন। অল্পদিনে তার অনুসারি ভক্তবৃন্দ বাড়তে থাকে। নের্তৃত্ব দেয়ার মোহে পড়ে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী দাবি করেন। নিজেকে হযরত ইমাম মাহদী (আ.), আবার ইমাম মাহদীকে (আ.) নবী দাবি করে তার প্রধান সেনাপতি হিসেবে পরিচয় দেয়া, ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মোসলমানদের বিভ্রান্ত করা, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে দুই ওয়াক্ত নামাজ, নতুন কালেমা ‘আব্বা আল্লাহ ইমাম মাহদী হুজ্জাতুল্লা’ প্রচার প্রচার চালাতে থাকেন তিনি। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য লুৎফর রহমান তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর থেকে লোকজনের তাড়া খেয়ে ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে তিনি বোরকা পড়ে ঢাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। এরপরে কোনো এক ল্যাংটা বাবার সান্নিধ্যে সাধনা শুরু করেন তিনি। হঠাৎ ঐ ল্যাংটা বাবা উধাও হন, তিনি জনসাধারণকে বুঝাতে থাকেন, তিনি ছিলেন ঈমাম মাহদী। উনি এখন সপ্তম আসমানে আছেন। আর লূৎফর রহমানই তার রেখে যাওয়া প্রধান সেনাপতি। ঢাকায় যাওয়ার পর প্রথমে সূত্রাপুরের ধূপখোলা মাঠের পাশে আখড়া গড়েন লুৎফর রহমান। ঢাকায়ও নিজেকে শক্ত অবস্থানে নিতে পারেনি। ফলে অল্প দিনেই তার মুখশ খুলে যায়। প্রকাশ পায় তার পর্দার আড়ালের সত্যিকার চরিত্র। ফলে ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পরেরদিন ৩১ জুলাই তাকে আটক করে পুলিশ। ২০০৭ সালে সূত্রাপুর এলাকায় একই কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন বেশ কিছুদিন জেল খাটেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আস্তানা গড়ে একই কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন। পরে এলাকার লোকজন তাকে গণধোলাই দিয়ে বের করে দেয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানায় তার নামে ২০০৯ সালে শাহাবাগ থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয় তার বিরুদ্ধে। এরপর তিনি গোপীবাগে একই কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
অভিযোগ পেয়ে ২০১১ সালের ১৪ অক্টোবর ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ২০১১ সালের ১৪ অক্টোবর গোপীবাগ ১ম লেনের এক বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগে পাঁচ সহযোগীসহ ইমাম মাহদী (আ.)-এর সেনাপতি পরিচয়দানকারী এই লুৎফর রহমান ফারুক গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মাঝে গোপীবাগে খুন হওয়া মনির ও শাহীনও ছিল।
সূত্র: সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম, বাংলাদেশ প্রতিদিন