গর্জে উঠল বাংলাদেশ, টাইগারদের দাপটে কুপোকাত কিউইরা

01/11/2013 3:12 amViews: 18

1441000000মহিউদ্দিন পলাশ : শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সবুজ টার্ফে বৃহস্পতিবার কিউইদের বিপক্ষে খেলতে নেমে বাংলাদেশ যেভাবে গর্জে উঠেছে, তার যোগ্য প্রতিদান হিসেবে ওয়ানডে সিরিজ নিশ্চিত হয়েছে। তাই গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই বলে ফেলা যায়, কল্পনার সাগরে সাঁতার কাটার দিন শেষ। ঘরে বসে চাঁদ দেখার ইচ্ছে এখন আর বোনে না বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। স্বপ্নকে বাস্তবে নামিয়ে আনার মন্ত্র বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। ক্রিকেটকুলীন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবারও একদিনের সিরিজ জিতেছে মুশফিকুর রহীম বাহিনী। ২২ গজের লড়াইয়ে জয় এসেছে ৪০ রানে। এবার পালা ‘বাংলাওয়াশ’-এর। যার প্রথম রূপায়ণ হয়েছিল ২০১০ সালে।

চার ম্যাচের সব কয়টিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বে জন্ম দিয়েছিল নতুন এ শব্দের। এবার নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশ সফরে আসার পর বারবার মুখে উচ্চারিত হয়েছে শব্দটি। বিশেষ করে একদিনের সিরিজ সামনে রেখে।নিউজিল্যান্ড দলও শুনতে শুনতে ত্যক্ত-বিরক্ত। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে তারা নারাজ; কিন্তু মুশফিক বাহিনীর উজ্জীবিত তারুণ্যের কাছে তারা দাঁড়াতে পারেনি। এবারের বাংলাদেশ সফরে একটিবারের জন্যও তারা আকাশে উড়তে পারেনি। সমান সমান নৈপুণ্যে টেস্ট সিরিজ ড্র। তারপর শুরু একদিনের সিরিজ, যেখানে প্রথম ম্যাচ জিতেছিল স্বাগতিকরা। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় ম্যাচেও ঘায়েল সফররতরা। আক্ষরিক অর্থে সিরিজের শুরু থেকে আকাশে উড়ে থাকলে বাংলাদেশ দলই উড়ছিল। সিরিজ জয় নিশ্চিত করে আকাশে ওড়া অব্যাহত রেখেছে। এবার তা টেনে নিয়ে যাওয়ার পালা ‘বাংলাওয়াশ’ পর্বে।

সিরিজ হারের পর এখন নিউজিল্যান্ড বাংলাওয়াশের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে বাংলাওয়াশ ঠেকাতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ফতুল্লায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়।

পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও। আগে তারা একটি জয় পেলেই বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠত। এখন আর জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয় না। জয় অনেকটা আয়াসসাধ্য করে তুলেছে তারা। এখন উচ্ছ্বাস করার জন্য তারা আরও বড় অর্জনের অপেক্ষায় থাকে, যে কারণে প্রথম একদিনের ম্যাচে জয়ের পর ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি ছিল গতানুগতিক। সেখানে দ্বিতীয় ম্যাচ জয়ের মাধ্যমে সিরিজ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ক্রিকেটারদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে উত্সবের রং। শেষ উইকেট নিয়েছিলেন মাশরাফি; কিন্তু উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। তাই উত্সবটা শুরু করেন তিনিই। হাতে তুলে নেন স্ট্যাম্প। তারপর যে যেভাবে পেরেছেন, উত্সবে হয়েছেন মাতোয়ারা। সবাই স্মারক হিসেবে অন্তত ছয়টি স্ট্যাম্পের একটি করে নিতে চেয়েছেন; কিন্তু ১১ জনের পক্ষেতো আর একটি করে নেয়া সম্ভব নয়! এখানে আবার ব্যতিক্রম সামসুর রহমান শুভর ক্ষেত্রে। বৃহস্পতিবারই তার অভিষেক হয়েছে। আর প্রথম ম্যাচেই পেয়েছেন জয়ের সঙ্গে সিরিজ জয়ের উপলক্ষ; কিন্তু স্মারক হিসেবে তিনি কোনো স্ট্যাম্প ভাগে পাননি। অগত্যা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কাছ থেকে একটি চেয়ে নেন। তারপর চলে লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়িয়ে স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ। সঙ্গে ছিল দর্শকদের গগনবিদারী আওয়াজ ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। জয়-পরাজয়ের মাঝে ব্যবধান ৪০ রানের। দেখে মনে হবে বাংলাদেশ দল বিনা বাধায় দিয়েছে লক্ষ-যোজন পাড়ি; কিন্তু ম্যাচের চিত্রনাট্য তা বলে না। ম্যাচ দুলেছে পেন্ডুলামের মতো। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হওয়ার পর কখনও মনে হয়নি এ রান জয়ের মতো। আবার নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের শুরুতে ৪৫ রানে তিন উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচের ড্রাইভিং আসনে বসেছিল স্বাগতিকরা। রস টেলর ও কোরি অ্যান্ডারসন মিলে আবার ড্রাইভিং আসনে বসার চেষ্টায় রত ছিলেন। সেখান থেকে তাদের আবার ছিটকে ফেলে দেন বাংলাদেশের বোলাররা। এরপর ম্যাচের আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাচের চিত্রনাট্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে— ‘বাংলাদেশের জয়’।

প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ ২৬৫ রান করেও জয় পেয়েছিল ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির সঙ্গে পেসার রুবেলের হ্যাটট্রিকসহ ছয় উইকেট; কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচের পুঁজি আরও কম ২৪৭ রান হওয়ার পরও বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছে বোলারদের কল্যাণে। সেখানে ছিল পেস ও স্পিনের সম্মিলিত আক্রমণ। মাশরাফি প্রথম ও শেষ উইকেটসহ তিন উইকেট নিয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। রাদারফোর্ডকে দিয়ে শুরু টিম সাউদিকে দিয়ে শেষ। মাঝে যখন কোরি অ্যান্ডারসন রস টেলরকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখনই মাশরাফি আঘাত হানেন অ্যান্ডারসনকে ফিরিয়ে দিয়ে। তেমনি সোহাগ গাজীর ঘূর্ণিবলের ভেল্কিতে তিন উইকেটও ছিল খুবই কার্যকর। ইনিংস শুরুর আরেক পার্টনার ডেভচিচকে এগোতে দেননি। চুইংগামের মতো ইনিংস টেনে নেয়ার আগেই আঘাত হানেন সোহাগ গাজী। এরপর অ্যান্ডারসন ফিরে যাওয়ার পর রস টেলরযখন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ঘাতক হয়ে ওঠেন সোহাগ গাজী। তার আগে তিনি নিশামকেও ফিরিয়ে দেন। রাজ্জাকও শুরুর তিন উইকেটের একটির মালিক হয়ে গেছেন।

এদিকে মাহমুদউল্লার বল খেলতে খেলতে বিব্রত হলেও উইকেট পাচ্ছিলেন না। রাজ্জাকও আর উইকেট পাচ্ছেন না। এ সময় দলপতি মুশফিকুর রহীম তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেন মুমিনুলকে। তিনি অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দেন দুই ভাই অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও নাথান ম্যাককালামকে আউট করে। এটি ছিল তাদের পঞ্চম ও নবম উইকেটের পতন। অপর উইকেটটি ছিলরান আউট। আর এভাবেই রচিত হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরও একটি নতুন ইতিহাস— ‘কিউই বধকাব্য’।

বোলারাদের হাত ধরে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তার সূচনা কিন্তু ছিল ব্যাটসম্যানদের পক্ষ থেকে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ দল টসে হেরে ব্যাটিং করতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে মুদ্রা নিক্ষেপণে তারা আর হার মানেনি; কিন্তু অধিনায়ক মুশফিক ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। ইনিংসে যে সংগ্রহ তা অবশ্য মনোপূত হওয়ার কথা নয়। তবে যেখানে এসে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয়েছে, সূচনায় সে রকম ইঙ্গিত ছিল না। সেখানে সম্ভাবনার আলো জ্বলেছিল আরও বেশি সংগ্রহের। এ আলো জ্বালিয়েছিলেন তামিম ইকবালের সঙ্গে এনামুল হক বিজয়ের পরিবর্তে খেলতে নামা শামসুর রহমান শুভ; কিন্তু ১৬৯ থেকে ১৭৩— দলীয় এ রানের মধ্যে বাংলাদেশ একে একে মুশফিকুর রহীম, নাঈম ইসলাম ও নাসির হোসেনকে হারিয়ে যে ধাক্কা খায়, যার পরিণতি বরণ করতে হয়, এক ওভার হাতে রেখেই ২৪৭ রানে অলআউট হয়ে।

তামিম ও শামসুর উদ্বোধনী জুটিতে ভালো সূচনা এনে দিলেও রান সংগ্রহের গতি ছিল ধীরলয়ে। ৬৩ রান আসে ১৬.৫ ওভারে। বেশি ধীরে খেলেছেন শামসুর। ৫৪ বলে ২৫ রান করে তিনি নাথান ম্যাককালামের শিকার হন। তবে শামসুরের (২৫) বিদায়ের পর তামিম ও টেস্ট সিরিজের সেরা ক্রিকেটার মুমিনুল তাল মিলিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে রানের গতিও বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। জুটিতে ৪৭ রান আসার পর মুমিনুল (৩১) বিদায় নেন। এদিকে তামিম ইকবাল আদায় করে নেন ক্যারিয়ারের ২৫তম ফিফটি। ৭৫ বলে ফিফটি পূর্ণ করার পর তিনি আর বেশি দূর যেতে পারেননি। ৮৬ বলে ৫৮ রান করে তিনি অ্যান্ডারসনের বলে বোল্ড হয়ে যান। তার ইনিংসে ছিল একটি ছয় ও পাঁচটি চার।এ দিন তামিম ইকবাল একদিনের ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী সাকিবকে ছাড়িয়ে যান। তামিম আউট হওয়ার পর মুশফিকুর প্রথম ম্যাচের মতো আবারও হাল ধরেছিলেন; কিন্তু ভুল শট খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেন ব্যক্তিগত ৩১ রানে। ১৭৩ রানে ষষ্ঠ উইকেটের পতন হওয়ার পর সপ্তম উইকেট জুটিতে মাহমুদউল্লাহ (২১) ও সোহাগ গাজী (২৬) ৪৮ রান যোগ করলে বাংলাদেশের ইনিংস ফাইট করার মতো পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে।এ জুটি বিদায়ের পর সাত রানে পড়ে বাংলাদেশের শেষ তিন উইকেট।

Leave a Reply