ক্যালসিয়ামের জন্য দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারের কতটুকু প্রয়োজন
ক্যালসিয়াম ব্যাপারটি নিয়ে সবসময় তর্ক আছেই। সবচেয়ে বড় তর্ক হলো দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার ছাড়াই আমাদের অন্যান্য খাবার ও উদ্ভিদ-জাত খাবার থেকে আমরা যথেষ্ট ক্যালসিয়াম পেতে পারি কিনা।
ক্যালসিয়াম নিয়ে কিছু কমন প্রশ্ন হলো –
আমার কী পরিমাণ ক্যালসিয়াম দরকার?
শুধুমাত্র শাক-সব্জি থেকে কি আমি যথেষ্ট ক্যালসিয়াম পাব?
ক্যালসিয়াম কেন গুরুত্বপূর্ণ?
কী কারণে দেহ থেকে ক্যালসিয়াম চলে যায়?
ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে কি ক্যালসিয়াম ঘটিত সমস্যা দূর করা সম্ভব?
ক্যালসিয়াম বিষয়ে স্পষ্টতার জন্য উপরের প্রশ্নগুলি একটা একটা করে আলোচনা করা যাক।
আমার কি পরিমাণ ক্যালসিয়াম দরকার?
বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ১০০০-১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম দরকার। তবে যেসব বিশেষজ্ঞরা খাবার হিসেবে শুধুমাত্র শাক-সব্জির পক্ষে তারা বলেন, সাধারণত একটি কারণে এত বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়াম লাগে—বেশি প্রাণীজ প্রোটিন খাওয়ার কারণে বেশি রেচন ক্রিয়া ঘটে, ফলে দেহ থেকে বের হয়ে যাওয়া ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণ করার জন্য এত বেশি পরিমাণ ক্যালসিয়ামের দরকার হয়।
আর শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ও উদ্ভিদ-জাত খাবার খেলে দেহ থেকে কম ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়, এই কারণে নিরামিশাষী ব্যক্তির ক্যালসিয়াম গ্রহণের পরিমাণ কম থাকতে পারে।
কত কম?—দ্য আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন অনুসারে, যে ব্যক্তি যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিমানসহ, কিন্তু কম সোডিয়াম ও প্রোটিন গ্রহণ করে তার জন্য প্রতিদিন ৫০০-৭৪১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম দরকার।
শুধুমাত্র শাক-সব্জি থেকে কি যথেষ্ট ক্যালসিয়াম পাওয়া সম্ভব?
আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম ও কপারের মত ক্যালসিয়ামও একটি খনিজ উপাদান। ক্যালসিয়াম থাকে মাটিতে, আর মাটি থেকে উদ্ভিদ শেকড়ের মাধ্যমে তা গ্রহণ করে। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ উদ্ভিদ জাতীয় খাবার খেয়েই প্রাণীরা ক্যালসিয়াম পায়। আমরা যদিও বিশ্বাস করে থাকি যে দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারই ক্যালসিয়ামের সবচেয়ে ভালো উৎস, কিন্তু আসল ঘটনা হল, সবচেয়ে বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে মাটিতে। প্রাকৃতিক জিনিস বা শাক-সব্জিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে।
শর্করা, শাক-সব্জি ও ফলমূলে আমাদের চাহিদা পূরণ করার মত যথেষ্ট ক্যালসিয়াম আছে। আপনি যদি কম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান, আপনার শরীর তার সাথে মানিয়ে নেবে। গবেষণায় দেখা গেছে কম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেলে আমাদের পরিপাকতন্ত্র খাবার থেকে ভালোভাবে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে এমং আমাদের কিডনি ভালোভাবে ক্যালসিয়াম সংরক্ষণ করতে পারে। আবার যখন অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম (১৭৪০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন) গ্রহণ করা হয় তখনো আমাদের শরীর তার সাথে মানিয়ে নেয়; পরিপাকতন্ত্র কম ক্যালসিয়াম শোষণ করে এবং আমাদের কিডনি অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বের করে দেয়। আর যদি অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম বের না হতে পারে তাহলে সেগুলি আমাদের সফট টিস্যুতে জমা হয় (হার্ট, কিডনি, মাসল ও ত্বক), এতে শরীরে অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক খাবার ও শাক-সব্জি খাওয়ার পরেও ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত কোনো রোগ হওয়া অসম্ভব একটি ব্যাপার।
আমরা যে পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করি তার কতটুকু দেহ শোষণ করে নেয়?
আমাদের শরীর কী পরিমাণ ক্যালসিয়াম শোষণ করে, তার তুলনায় আমরা কী পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ করি তা কম গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, এক কাপ দুধে ৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। এর শতকরা ৩০ ভাগ অর্থাৎ ৯০ মিলিগ্রাম শোষণযোগ্য, অর্থাৎ এই ৩০০ মিলিগ্রামের মাত্র ৯০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম আমাদের শরীর শোষণ করে।
গরুর দুধ ও অন্যান্য শাক-সব্জি থেকে শরীরের ক্যালসিয়াম শোষণের হার তুলনা করে দেখা যাক।
টফুতে শোষণযোগ্য গরুর দুধের পরিমাণ গরুর দুধের মতই। এটা ৩১ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে।
চাইনিজ মাস্টার্ড গ্রিনে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে, এর শোষণযোগ্য ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ৪০ শতাংশ।
২ কাপ ব্রকোলিতে এক গ্লাস দুধের সমান পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, তবে ব্রকোলি থেকে ৫০-৬০ শতাংশ ক্যালসিয়াম শোষণযোগ্য।
২ কাপ ব্রকোলিতে এক গ্লাস দুধের সমান পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, তবে ব্রকোলি থেকে ৫০-৬০ শতাংশ ক্যালসিয়াম শোষণযোগ্য।
২ কাপ ব্রকোলিতে এক গ্লাস দুধের সমান পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, তবে ব্রকোলি থেকে ৫০-৬০ শতাংশ ক্যালসিয়াম শোষণযোগ্য।
কী কারণে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম হারায়?
অনেক কারণেই শরীর থেকে ক্যালসিয়াম হারায়। যেমন বয়স বেশি হলে, শরীরে ভিটামিন ডি-থ্রি কম হলে। ব্যাপারটা অনেক সময় আপনার পরিপাকতন্ত্রের অবস্থার ওপরও নির্ভর করে। সোডিয়াম, প্রোটিন ও ক্যাফেইন ক্যালসিয়াম হারানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সোডিয়াম: ক্যালসিয়াম হারানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়ী সোডিয়াম। প্রতি ১০০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম (২৫০০ মিলিগ্রাম খাওয়ার লবণ) শরীর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ৪০-৬০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায়।
প্রোটিন: প্রোটিন বেশি গ্রহণ করলে রেচন প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম বের হয়ে যাওয়ার হার বেড়ে যায়। আপনি যখন স্বাভাবিকের দুইগুণ বেশি প্রোটিন খাবেন, তখন রেচনের মাধ্যমে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম হারানোর পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়।
কিন্তু দুধ বা দুগ্ধজাত খাবারের ক্যালসিয়াম হারানোর ক্ষেত্রে প্রোটিনের প্রবণতা ইন্টারেস্টিং। দুধ থেকে পাওয়া ক্যালসিয়াম ১/৩ অংশ হারায় আর চীজ বা পনির থেকে পাওয়া ক্যালসিয়াম হারায় ২/৩ অংশ।
ক্যাফেইন: ক্যাফেইনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্যালসিয়াম শরীর থেকে বের করে দেয়।
তবে অনেক শাক-সব্জি থেকে যে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় তার অধিকাংশই শোষণযোগ্য এবং তা সহজে হারায়ও না।
ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে কি ক্যালসিয়াম ঘটিত সমস্যা দূর করা সম্ভব?
গবেষণায় দেখা গেছে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে হাড়ের ফ্র্যাকচার হওয়ার ঝুঁকি ১০ শতাংশ কমে যায়। তবে এর সাথে সাথে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনিতে পাথর ও পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যাদের বয়স কম এবং যারা কম ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খান তাদের জন্য ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা যদি দুধ না খাই অথবা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ না করি তাহলে আমাদের হাড়ের কী হবে?
সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আমিষাশী ও নিরামিশাষীদের মধ্যে কার হাড়ের অবস্থা বেশি ভালো? ফলাফল আশ্চর্যজনক। দেখা গেছে নিরামিশাষী ও যারা মাংস খায় উভয়ের হাড়ের ঘনত্ব একই।
ক্যালসিয়ামের জন্য আপনার দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার অথবা সাপ্লিমেন্টের দরকার নেই। আপনি যদি যথেষ্ট পরিমাণে প্রাকৃতিক খাবার, উদ্ভিদ-জাত খাবার খান এবং বাড়তি সোডিয়াম খাওয়া পরিহার করেন তাহলেই আপনি আপনার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম পেয়ে যাবেন।