কোথায় পাব তারে
কোথায় পাব তারে
লালের সঙ্গে নীল মেশালে বেগুনি, আবার নীলের মধ্যে হলুদ দিলে সবুজ, অথচ অন্ধকারের সঙ্গে মেশালে প্রতিটা রং হয়ে যায় কালো। কুয়াশাঘেরা মধ্যরাতে মেয়েটির শাড়ির রং, গায়ের রং, সবকিছুই বিস্তীর্ণ অন্ধকারের সঙ্গে মিশে ছিল। পরে তার কথা ভেবে চোখ বুজলে তাকে সাদাকালো ছবির মতো দেখতাম। বিন্দুমাত্র আলোর প্রতিফলন ছাড়াই মেয়েটির গালের ওপর চকচকে আভা ছিল, নাকের ডগায় আর খুতনিতে ঘামের কয়েকটি স্বচ্ছ ফোঁটা তার মতোই ভয়ে-আশঙ্কায় থরথর করে কাঁপছিল। পরে বুঝেছিলাম, নভেম্বরের শুরুতে সিলেট অঞ্চলের ওই তুমুল শীতেও কতটা তীব্র উত্তেজনায় ওভাবে কেউ ঘামতে পারে।
যে রাতে মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম, কেবল প্রথম নয়—প্রথম এবং শেষ, তারপর আর কখনোই আমি তাকে দেখিনি, সেই রাতের আগের দিনের কথা বলছি। কালনী নদীর পাড়ের ধিরাই গ্রামে ছিল এক বিশাল বাঁশবাগান। বাঁশের পাতাগুলোর দিকে তাকালে কানের মধ্যে ঝিরিঝিরি শব্দ হতো। ওই শীতেও পাতাগুলো তেলতেলে। ওই অঞ্চলের মতো সরু বাঁশের পাতা দেখে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। বাঁশবাগানের পাশে পাতার ছাউনি দেওয়া এক কৃষকের বাড়ির জানালা দিয়ে তাই পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ধিরাই গ্রামের কৃষকের বাড়িটিতে আমরা ১৫ জন আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের ক্যাম্প ছিল দূরে। রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প থেকে অল্পস্বল্প গোলাবারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একদিন সেই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম। নদীর উল্টো দিকে শাল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের আস্তানাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ক্যাম্প থেকে এতটা দূরত্ব পেরিয়ে এসে এক রাতের মধ্যে নদী পার হয়ে সেখানে হামলা করা কোনো কাজের কথা হতো না। তাই হামলার পাঁচ দিন আগে আমরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ওখানে থাকা শুরু করলাম। রাতের অন্ধকারে অস্ত্র আর খাবারের ব্যাগগুলো কৌশলে কয়েক মাইল দূরত্ব পার করে সেই বাড়িতে এনে জমা করতে লাগলাম। আমাদের জন্য পাশের দেশ হয়ে কিছু খাবার আসত। বেশির ভাগ আসত টিনে অথবা প্যাকেটে ভরা সামুদ্রিক মাছ। সেসব কবে নদী কিংবা স্থলপথে আমাদের ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা দিত, কে জানে। হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে টিনের কোথাও ফেটে, প্যাকেট ছিঁড়ে মাছগুলোতে ছোট ছোট পোকা হয়ে যেত। ক্যাম্প থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে সেই টিন আর প্যাকেটগুলো ঘাড়ে করে নিয়ে যেদিন আমাদের গোপন আস্তানা, কৃষকের ওই বাড়িতে পৌঁছেছিলাম, দেখলাম ঘাড় বেয়ে পোকাগুলো আমার শরীরে নেমে এসেছে, সারা গায়ে সাদা সাদা পোকারা কিলবিল করছে। হয়তো শীতে, কিংবা আতঙ্কে তাদের উপস্থিতি আমি টের পাইনি। পৌঁছানোর লক্ষ্য যখন দৃঢ় হয়ে ওঠে, তখন ছোটখাটো অস্বস্তি জানান দেয় না। টিনগুলো জায়গামতো রেখে নির্বিকার পায়ে বাইরের অন্ধকারে গিয়ে গায়ের কাপড় খুলে ঝেড়ে নিয়েছিলাম। তা ছাড়া পৌঁছানোর প্রথম শর্ত তো বেঁচে থাকা, তাই পোকা বেছে নিয়ে শুকনো রুটি পেঁচিয়ে মাছগুলো খেতে আমাদের কখনো খারাপ লাগেনি। মাসখানেক আগে ছাতকের বিজয়ের পরে মনোবল এত বেড়ে গিয়েছিল যে আমরা তখন উড়ন্ত জাহাজে ঢিল ছুড়তে পারি, সামান্য অস্ত্রসহ বুক পেতে এক প্লাটুন মিলিটারির মোকাবিলা করতে পারি।
ওই বাড়ির জানালার পাশে, ওটা ঠিক জানালা নয়—বেড়াটা চৌকো করে কিছু অংশ কেটে রাখা, সেই চৌকো ফাঁকের পাশে ঘরটির কঙ্কালের পাঁজরের হাড়ের মতো একটা বাঁশে হেলান দিয়ে আমি বাঁশবাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ঘরের খুঁটি সেই বাঁশটির দুটো গিঁটের মাঝামাঝি পয়সা জমানোর জন্য দেড় ইঞ্চিমতো কাটা। ওই কাটা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতাম, যে মিশনে যাচ্ছি সেটাই জীবনের শেষ মিশন হতে পারে, জীবনের শেষ রাতগুলোর কথা লিখে এখানে একটা চিঠি ফেলে রেখে যাব কি? কেউ কোনো দিন পাবে, কোনো দিন কেউ তো অন্তত জানবে যে এই ধূসর আকাশ, এলোমেলো বাঁশের বাগান, ওই লাল পাথুরে মাটি, এই সমস্ত কিছুর জন্য একজন মানুষ নিজের অস্তিত্ব বাজি রেখেছিল! বাজিই বটে, কারণ তখন বুঝতে পারতাম, স্বাধীনতাই একমাত্র ধারণা, যার প্রভাবে মানুষ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাড়নায় আস্ত অস্তিত্বটাই বাজি রাখে।
একটা নির্দিষ্ট রাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমরা। বাঁশগাছগুলোর সবচেয়ে উঁচু হেলে পড়া ডগাটাকে অতিক্রম করে আমার দৃষ্টি প্রায়ই ওপরে চলে যেত; কিছুই পেত না অবশ্য। উপুড় করা ঘোলা কুয়াশার ঢাকনা কেবল ঘিরে রাখত বাড়িটাকে। সমস্ত আকাশ আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের কথা বলত তখন, বলত কেবল একটিই শব্দ—অনিশ্চয়তা। জানালা গলে দিন গড়িয়ে যাওয়া দেখতাম, দেখতাম কী করে সামান্য রোদের ঝিলিক এসে রাতকে দখল করে আর বিকেলের আবছায়া এসে হটিয়ে দেয় উজ্জ্বল আলোকে; মন বলত, আমাদের অনিশ্চয়তাও একদিন থাকবে না।
কথা ছিল পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে চাঁদের আলোর সম্ভাবনা একেবারে অনুপস্থিত হয়ে এলে আমরা নদীর অন্য তীরের শাল্লা গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেব। কিন্তু কথা নেই বার্তা নেই যে রাতে আমরা যাব, সেদিন সকালে সেখান থেকে পাকিস্তান আর্মি ধিরাই গ্রামে এসে উপস্থিত। তারা কি ওই গ্রামে আমাদের অস্তিত্বের কথা জেনে ফেলেছিল? এটা এখনো আমার কাছে ধাঁধা হয়ে আছে। যেদিন রাতে আমরা তাদের ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা দেব বলে ঠিক করেছিলাম, তারা এসেছিল সেদিন সকাল ১০টায়। থমথমে পরিস্থিতিতেও এ রকম সময়ে গ্রামের লোকেরা ঘর থেকে বেরোত, জীবনের আরেকটি নতুন দিনে পা রাখায় অবিশ্বাসের চোখে পৃথিবীর দিকে তাকাত। কেউ জীবনের প্রয়োজনে পসরা নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটা দিত, আর কেউ জীবনের প্রয়োজনেই যেত সেসব কিনতে। যার বাড়িতে আমরা ছিলাম, তার ১২ বছর বয়সী ছেলে সকাল সকাল কচি বাঁশের কঞ্চি হাতে ছুটে এল, ‘মিলেটারই আইছে, মিলেটারই আইছে’—শেষ হেমন্তের ধান মাড়াই ফেলে রেখে উঠানের মাঝখান থেকে ছেলেটির বাবা ছুটে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। ধানের তুষ লেগে থাকা ঘন ভ্রু কুঁচকে বাচ্চাটার দিকে গনগনে চোখে তাকিয়ে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ব্যবহারের সমস্ত কিছু খড়ের গাদায় ঢোকানো হয়ে গেল। সামান্য কিছু অস্ত্রসহ আমরা আশ্রয় নিলাম বাড়ির পেছনের ডোবায়। শীতে শুকাতে শুকাতে সেখানে পানি কম আর জোঁকে পূর্ণ। শীতল পানিতে ডুবে ডুবে রুদ্ধশ্বাস দুপুর পার করলাম আমরা। অথচ কী অদ্ভুত কারণে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের শেষ প্রান্তের বাঁশবাগান পেরিয়ে ওই বাড়িটাতে এল না। একসময় সেই ছেলেসহ তার বাবা এসে মিলিটারির ফিরে যাওয়ার কথা জানাল। ডোবার পানিতে ডুবে থাকার সময়ে আমাদের মধ্যে একজনের পায়ুপথে একটা জোঁক সোজা ঢুকে গেল তার পেটে। মিলিটারি চলে যাওয়ার কথা শুনতেই সে পড়ি কি মরি করে উঠে এল পানি থেকে। এতক্ষণ যে চিৎকার সে গোপন করে রেখেছিল, মিলিটারি চলে যাওয়ার খবরে লাল উঠানের এ-মাথা ও-মাথা গড়াগড়ির সঙ্গে সঙ্গে সেসব চিৎকার তারস্বরে তার গলা দিয়ে আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এল। পানিতে এক পোয়া লবণ গুলিয়ে চেপে ধরে তাকে খাইয়ে দেওয়া হলো। বিকেলের পড়ে যাওয়া আলোর সঙ্গে সঙ্গে তার আর্তনাদও দমে এল। কুয়াশার মধ্যে চাদরে গা-মাথা পেঁচিয়ে আমরা গ্রামের পরিস্থিতি দেখতে বেরোলাম তার পরপর। চোখে কিছু দেখার আগেই রক্তের গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। বাড়ি আছে, দেয়াল নেই। ঘর আছে, মানুষ নেই। যেন ভয়ার্ত কোনো জনগোষ্ঠী রাতারাতি জায়গা বদল করেছে। উঠানের এক ধারে উন্মুক্ত কোনো চুলায় তখনো ধোঁয়া উঠছে, পাশে রক্তের সরু ধারা এসে থমকে আছে। কোথাও ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে দু-তিনটে লাশ, লেপ্টালেপ্টি করে; যেন আজন্মের বন্ধুত্ব ছিল তাদের। কোথাও উঁচু লাল মাটির বারান্দায় নিষ্প্রাণ উলঙ্গ নারী উন্মুক্ত চোখে গভীর অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে। কোথাও দুটো শিশু দুদিক থেকে তাদের মায়ের লাশ ধরে টানাটানি করছে, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়।
আমাদের উপস্থিতিতে গ্রামে এমন অনাচার ঘটে গেল, এ যেন আমাদেরই অপারগতা। ফিরে গিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। রাত ১০টা বাজতেই রওনা। নদী পেরিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা করা আমাদের উদ্দেশ্য। অস্ত্রসহ গুটি গুটি হেঁটে কালনী নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। দিনের বেলা দেখা জায়গাগুলো অন্ধকারে অপরিচিত, কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ানো রক্তের গন্ধটা চেনা। দুই দিন আগে নৌকাবাঁধা যে ঘাট হয়ে দ্রুত অন্য পারে চলে যাব বলে ঠিক করা হয়েছিল, সেখানে এসে দেখলাম কেবলই স্থির কালো পানি, নৌকার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের দলের কারও কারও নিশ্চিত জানা ছিল যে কালনীর ঠিক ওই ঘাটটাতে বাঁশের সঙ্গে কয়েকটা নৌকা বাঁধা থাকে। ভাবলাম, অন্ধকারে দিকনিশানা ভুল হলো না তো? আমাদের চামড়ায় তত দিনে কালশিটে ধরে গেছে, সামান্য ছড়িয়ে গিয়ে নৌকা খুঁজতে গেলে মনে হলো প্রত্যেকে একা, অন্ধকারে সামান্য দূরত্বে উধাও। পায়ের নিচে ধারালো কাঁকর আর বালুর অস্তিত্বই কেবল পরিচিত যেন। ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, অথচ নৌকাগুলো হারিয়ে ফেলেছি ভেবে অসহায় লাগল। কিন্তু ছোট্ট একটা খালের মতো নদীর কাছে হেরে যাব? ওই গোলাবারুদ নিয়ে সাঁতরে গেলে সেসব আর কোনো কাজে আসবে না। এত দিনের প্রস্তুতি নেওয়া মিশনটা ভেস্তে যাচ্ছে ভেবে বালুর ওপরে আছড়ে পড়তে ইচ্ছা হলো। এদিকে কী যেন এক অদম্য ঘৃণা বা ক্রোধ সারা শরীরে তুমুল ছোটাছুটি করছিল। কালো কুচকুচে পানির দিকে তাকিয়ে বিকেলে দেখা ক্ষতবিক্ষত লাশগুলোর মরীচিকা দেখতে লাগলাম। উদ্ভ্রান্তের মতো আশপাশের বেশ খানিকটা এলাকা খুঁজে এসে অথর্ব আমরা সেই ঘাটে স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। কোনো কথা নেই তখন আমাদের মুখে, হাতের ভারী অস্ত্রগুলো মাটিতে রাখতেও ভুলে গেলাম। তারপর হঠাৎ কেঁপে উঠলাম একটা কিছুর ধেয়ে আসা দেখে। বালুর শেষ প্রান্তের ঝোপঝাড়ে আলোড়ন তুলে কিছু যেন একটা বেরিয়ে আসছে, কোনো জন্তু কি? আসছে ঠিক আমাদের দিকেই। রাইফেল তাক করলাম। দৃষ্টিসীমার মধ্যে এলে দেখি মানুষ! একটা মেয়ে। ওই শীতে ফিনফিনে শাড়ি তার গায়ে কোনো রকমে জড়ানো। শাড়িটা হাঁটুর সামান্য নিচে নেমেই চওড়া পাড়ের বৃত্তে শেষ হয়ে গেছে, গায়ে ব্লাউজ নেই। কোমর ছাপানো কোঁকড়ানো অবিন্যস্ত চুলে ঘাড়-গলা ঢেকে আছে। আমাদের স্থির নির্লিপ্ত মুখের বিপরীতে তার মুখে উৎকণ্ঠা।
‘মুক্তি? মুক্তি নি?’ কাছে আসার সামান্য আগেই চিৎকার করছিল সে। কাছে এসে নিশ্চিত হয়ে নিল আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত বার কয়েক চোখ বুলিয়ে। তারপর আঙুল উঁচু করে একদিকে হাত বিস্তৃত করল, ‘ওবাইদি আও, আমি দেখছি। সব নাও ডুবাইয়া রাখছে। আমি জানতাম আফনারা আইবা।’ স্থবির হয়ে যাওয়া আমাদের শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হলো তখন। মেয়েটির দেখিয়ে দেওয়া দিকে ছুটে যেতে লাগলাম। সে এগোল আমাদের আগে আগে; যেতে যেতে একই উত্তেজনায় বলে গেল, ‘সারা গাওঅর মানুশে মারিয়া জাওয়ার শময় নাও অখল্রে ডুবাইয়া রাখিয়া গেলও। আমি দেখছি। আমি হেতুকুই জানতাম আফনারা আইবা।’
আমরা তাকে কোনো প্রশ্ন করিনি। তার কথায় বা উত্তেজনায় আমাদের ভেতরে কোনো ভাবাবেগও আসেনি। নদী পেরোনোর জন্য কোনো একটা উপায়ের তখন এত দরকার আমাদের যে সৌজন্য বলে কিছু ছিল না। সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা-ও ঘুণাক্ষরে ভাবিনি, জানতে চাইনি। উড়তে থাকা ফিনফিনে শাড়ির পেছনে অন্ধকারে অন্ধের মতো ছুটছিলাম শুধু। মনে হচ্ছিল, কুয়াশার পর্দা ছিঁড়েখুঁড়ে কেবল অনন্ত রহস্যের দিকে ছুটছি। সব জায়গা একই রকম কালো, এর মধ্যে সে কী করে নির্দিষ্ট জায়গাটা বের করে ফেলেছিল, আমার জানা নেই। রহস্যের শেষ হলো সেইখানে গিয়ে।
‘অউজে অখানও। ডুব দিয়া নাও উটাইতে অইবও’—বলে সে পানিতে হাঁটু পর্যন্ত নেমে গেল, দেরি যেন না হয়, তাই নিজেই ডুব দিয়ে সে নৌকাগুলো ভাসিয়ে দেবে। আমি পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলাম। সে থামল আর হাঁপাতে শুরু করল শেষ পর্যন্ত। আমাদের দলের দুজন ডুবে গিয়ে একটা একটা করে তিনটা নৌকা ওঠালে আমরা তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র নৌকায় রাখলাম। মেয়েটি ততক্ষণে ছুটে গিয়ে কোথা থেকে তিনটা বড় বাঁশ হাতে নিয়ে হাজির। ডুব দিয়ে লগি খোঁজার ঝামেলায় ফেলতে চায়নি আমাদের। খানিকটা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেও নৌকা ছাড়ার আগমুহূর্তে আবারও হাঁটুপানি পর্যন্ত এগিয়ে এল, ‘যাউ ক্কা, সবগুলারে মারিয়া আইঞ্জাইন। এখটাও জেনো বাছতে না ফারে।’ তারপর পেছনে অন্ধকারের দিকে অর্থহীনভাবে ইশারা করে বলল, ‘আমি হউ জুফর মাজখানে থাখমু। খেউ জেনো বাছতে না ফারে।’
নৌকা সামান্য এগোতেই উত্তেজিত মেয়েটি তো বটেই লম্বালম্বি তীরটাও হাওয়া হয়ে গেল। একই রকমের অন্ধকার কেটে কেটে অন্য পাড়ে গিয়ে নৌকা ঠেকল একসময়। ১৫ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে সামান্য আগে-পরে চলতে লাগলাম আমরা। আসন্ন মুখোমুখি যুদ্ধের সংকল্পের কাছে মেয়েটিসহ জীবনের পেছনের বাকি সমস্ত স্মৃতি তখন উবে গেছে। ঘাঁটিটাতে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম পূর্বপরিকল্পনামতো। মাঝরাতে গোলাগুলির শব্দে শাল্লা আর মিলনবাজার এলাকার মানুষ ছুটে এল খানিক পরে। শত মানুষ এক হয়ে শত্রুদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারলাম সত্যি, ঠিক ওই মেয়েটির ইচ্ছার মতো।
ফিরে আসতে আসতে পরদিন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল। কমবেশি সবাই খোঁড়াচ্ছিলাম। গিয়েছিলাম ১৫ জন, ফিরেছি ১১। মুখে কোনো কথা ছিল না, চোখেও কোনো পানি ছিল না আমাদের। ধুলো-রক্ত-ঘামে মিশে শরীরে কেবল একটা বাড়তি চামড়া বসে গিয়েছিল। কয়েক মাস ধরে দু-তিনটে গ্রামের লোকদের ওপর চালানো অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। তবু আমরা জানতাম যে ফুর্তি করার সময় হয়নি তখনো, আরও অনেক বাকি। ফেরার সময় নৌকা ঠিক সেখানেই স্থির ছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। গ্রামের মানুষ আমাদের ধরাধরি করে নৌকায় উঠিয়েছিল, বেয়ে নদী পার করিয়েছিল। তীরে পৌঁছে ওই মেয়ের কথা বা তার প্রতিশ্রুত অপেক্ষা করার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি।
তাকে আমার মনে পড়ল তিন দিন পরে। কৃষকের বাড়িতে শুয়ে জানালা দিয়ে যে সন্ধ্যায় বাইরের অন্ধকারকে অনায়াসে বাঁশঝাড়সমেত বাড়িটাকে গ্রাস করতে দেখছিলাম, সেই সন্ধ্যায় অন্ধকারের কালোর মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো তার মুখ ভেসে উঠল। ঊরুতে গুলি লেগেছিল, খুঁড়িয়ে কোনো রকমে নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছালাম তখনই। কিন্তু তারপর? কোথায় খুঁজব তাকে? তিন দিন ধরে সে ওই ঝোপে অপেক্ষা করছে, এ তো অসম্ভব। ঝোপের পাশে গিয়ে ভাবলাম চিৎকার করে ডাকি তাকে, কিন্তু কী বলে ডাকব? আমি কি তার নাম জানতাম! ওই তুমুল শীত আর কুয়াশার মধ্যে মাঝরাতে কোথা থেকে সে উদয় হয়েছিল আর কোথায়ই-বা মিলিয়ে গেছে, কিছু নিয়েই বেশি দূর ভাবতে পারলাম না। বালুর মধ্যে ধপ করে বসে পড়ে মনে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করা হয়ে গেছে, কেন তার পরিচয় জানতে চাইনি? সবাইকে যে মারা হয়েছে, এই খবরটা তাকে জানানোও তো জরুরি ছিল!
দুশ্চিন্তায় ডুবে সে রাতটা পার করে সকাল হতেই ধিরাই গ্রামের যাকে সামনে পেলাম তাকেই মেয়েটির কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম। একেকটা বাড়িতে ঢুকে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে শুরু করলাম একসময়। কারও মুখের সঙ্গে মিলল না। কেউ বলতে পারল না। কেউ মানতেও পারল না ওই গ্রামে এমন কোনো মেয়ে আছে, যে ওরকম সময়ে মধ্যরাতে নদীর তীরে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষা করতে পারে। তাকে যে হারিয়ে ফেলেছি তা আমার জন্যও মানা কষ্টকর ছিল। গ্রামের মানুষজনের তখন একটাই মত, জানতে চাইলেই ঠোঁট উল্টে জানায়, এই সময়ে কে কোথা থেকে আসে আর রাতারাতি কে কোথায় চলে যায়, তার কি কোনো ঠিক আছে? ওই গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও খুঁজতে লাগলাম আমি; সেদিন, পরদিন, তারও পরদিন…
যুদ্ধ শেষ হলো। নিজের জায়গায় ফিরলাম। তৃপ্তির তুলনায় অতৃপ্তি বড় হতে লাগল। বারেবারে ধিরাই গ্রামে গিয়ে হাজির হলাম, যেতে থাকলাম কদিন বাদে বাদেই। অভিন্ন প্রশ্নসহ আমাকে গ্রামের মানুষদের মুখস্থ হয়ে গেল। মেয়েটির কোনো বর্ণনা দিতে পারি না। তার মুখের ওপর একে তো ছিল অন্ধকার, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠল ধুলো, ধীরে ধীরে স্মৃতির ওপর যা জমতে লাগল। প্রায়ই ভাবতাম, তার নাম কী হতে পারে, অঞ্জনা নদীর পাশে যদি রঞ্জনা থেকে থাকে, তবে কালনীর পাশে সে কি শালনী হতে পারে না? মনে মনে তাকে শালনী বলেই ভাবতাম। কিন্তু শালনীকে খুঁজে পেলে কী করব, সে পর্যন্ত ভাবনা এগোত না।
মনে নেই কবে ধিরাই যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। শুধু মনে আছে, শালনীকে আমি আর কখনো খুঁজে পাইনি। সবাইকে মারা হয়েছিল, জরুরি এ খবরটাও তাকে আর কখনো জানানো হয়নি।