কোটি মানুষের প্রিয় শিল্পী মান্না দে আর নেই
মোরসালিন মিজান ॥ সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবুু আছে/সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/শুধু সেই সেদিনের মালী নেই…। হ্যাঁ, চলে গেছেন মালী। চিরতরে। আর জমবে না প্রাণখোলা আড্ডা। মান্নাদের কফি হাউস হয়ে গেছে মান্না দের স্মৃতি শুধু। এখন সেখানে বিয়োগ ব্যথা। গোটা ভারত এবং বাংলাদেশে শোক। সারা পৃথিবীর বাংলাভাষীদের মন খারাপ। বড় ভালবাসার মানুষ প্রিয় শিল্পী পুজনীয় মান্না দে চলে গেছেন যে তাঁদের ছেড়ে। প্রায় সাত দশকের সঙ্গীত জীবন। বাংলা তো বটেই, অন্য অনেক ভাষায় গান করেছেন। সংখ্যায় তা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। সিনেমার গান, ধ্রুপদী সঙ্গীত, আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতিÑ সবখানে দরদী কণ্ঠ! সঙ্গীত সমজদারদের মতে, নানা আঙ্গিকের গান গাওয়ার সহজাত প্রতিভা মান্না দে। বিরল এই প্রতিভা উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী বৃহস্পতিবার ভোর ৩টা ৫০ মিনিটে ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। দুপুরে বেঙ্গালুরুর হিব্বল মহাশ্মশানে শিল্পীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত এই গায়কের মৃত্যুর খবরে ভারতসহ বাংলাদেশের সঙ্গীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। তবে যেখানে জন্ম, জীবনের স্বর্ণ সময় পার করেছেন যে শহরে সেই প্রিয় কলকাতায় কিংবা কফি হাউসে আনা সম্ভব হয়নি তাঁর মরদেহ।
জনকণ্ঠের কলকাতা প্রতিনিধি শুভদীপ বকসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে বুকের সংক্রমণ ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন মান্না দে। গত ৮ জুন অবস্থার আরও অবনতি হলে শিল্পীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে হাসপাতালেই ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার তাঁর ডায়ালিসিস হয়। অবশেষে বৃহস্পতিবার ভোরে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যান মান্না দে। ভক্তদের শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মরদেহ বেঙ্গালুরুর রবীন্দ্র কলা ক্ষেত্রে রাখা হয়। সেখানে প্রিয় শিল্পীকে চির বিদায় জানান ভক্ত অনুরাগীরা। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার অনুরোধ সত্ত্বেও মান্না দের মরদেহ জন্মস্থান কলকাতায় আনার অনুমতি দেয়নি শিল্পীর পরিবার। কী কারণে এমন সিদ্ধান্ত তা জানা যায়নি। তবে এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের শোক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মান্না দে ১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল প্রবোধচন্দ্র দে। বাবা পূর্ণচন্দ্র দে ও মা মহামায়া দেবী। লেখাপড়া করেছেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং বিদ্যাসাগর কলেজে। আর সঙ্গীত শিক্ষার শুরু কাকা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে। ১৯২০ ও ৩০-এর দশকের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন তিনি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী গায়কের শিষ্য ও সহকারী ছিলেন মান্না দে। ১৯৪২-এ কাকার হাত ধরেই তিনি বম্বে পাড়ি জমান। ওস্তাদ দবির খানের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন। শিখেছেন ওস্তাদ আমান আলি খান ও ওস্তাদ রহমান খানের কাছে। বিস্ময়কত তথ্য হচ্ছে, সঙ্গীত জীবন শুরুর মাত্র ৬ বছরের মধ্যে তিনি দেশের অন্যতম বিখ্যাত শিল্পীদের তালিকায় জায়গা করে নেন। বাংলা, হিন্দী, ভোজপুরি, পঞ্জাবী, কোঙ্কনি, অসমিয়া, ওড়িষ্যা, গুজরাতি, মরাঠিসহ বিভিন্ন ভাষায় তিনি সাড়ে তিন হাজারের মতো গান করেছেন। সিনেমায় গাওয়া শুরু করেন কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই। কাকার সঙ্গীত পরিচালনায় ‘তমন্না’ ছবিতে সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে প্রথম গান ‘জাগো আয়ে ঊষা, পঞ্ছি বোলে জাগো’ গানটি। এখানেই শেষ নয়। গান করার পাশাপাশি কৃষ্ণচন্দ্র ও শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেন তিনি। হিন্দী সিনেমায় তাঁর প্রথম একক হিট গানটি ছিল ‘উপর গগন বিশাল।’ সেটি ১৯৪৩ সালের কথা। পরে শচীন দেব বর্মণসহ বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকদের সুরে ১৯৪০, ৫০ ও ৬০-এর দশকে সিনেমায় অনেক কালজয়ী গান করেন তিনি। ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বলো’ গানটি তাঁর রেকর্ড করা প্রথম বাংলা গান। এটি ১৯৫৩ সালে রেকর্ড করা হয়। ৬০-এর দশক থেকে বাংলা সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেছেন। এখানেও তিনি ছিলেন বিপুল জনপ্রিয়। তাঁর বিখ্যাত বাংলা গানগুলোর মধ্যে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ ছাড়াও রয়েছে ‘এই কুলে আমি, ‘সেই তো আবার কাছে এলে, ‘ললিতা’, ‘ওকে আজ চলে যেতে বল না’, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’, ‘শাওন রাতে যদি’, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’, ‘আমি যে জলসাঘরে’ সহ অনেক গান। এসব গানের মাধ্যমে শ্রোতার হৃদয়ের মনিকোটায় স্থান করে নেন মান্না দে।
কর্মের স্বীকৃতিও হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কারও। নানাভাবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার প্রদান করে। ২০০৫ অর্জন করেন ‘পদ্মভূষণ’। ২০০৭ সালে লাভ করেন ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার। এ ছাড়াও ভারতের ৪টি জাতীয় পুরস্কার, রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি. লিট, আলাউদ্দিন খান পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন মান্না দে। এমন কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। এই ভালবাসা এই প্রেমের মৃত্যু হয় না।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ মান্না দের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, সুরেলা এই কণ্ঠ এই সঙ্গীত শৈলী কখনও ভুলবার নয়। উপমহাদেশের সঙ্গীতপ্রেমী জনগণের কাছে এই কিংবদন্তি শিল্পী চিরঞ্জীব থাকবেন। রাষ্ট্রপতি মান্না দের বিদ্রেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্খীদের প্রতি সমবেদনা জানান। অপর এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মান্না দে সঙ্গীত প্রিয় মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মান্না দের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। এক শোক বার্তায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী মান্না দের মৃত্যুতে সমগ্র বাংলাভাষীদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ জনকণ্ঠের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, মান্না দের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্র্জী বলেছেন, বহুমুখী প্রতিভার এক অসাধারণ শিল্পী ছিলেন মান্না দে। তাঁর গায়কী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অপর শোক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, আমি গভীরভাবে মর্মাহত। তিনি ছিলেন ‘সুরসম্রাট’। তাঁর গায়কী ছিল স্বতন্ত্র। তাঁর মৃত্যুতে ভারত এক জন কিংবদন্তি শিল্পীকে হারাল।
তারকাদের শোক ॥ মান্না দের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ট্যুইটারে লিখেছেন, সঙ্গীত জগতের একজন মহীরুহ চলে গেলেন। শব্দ বেঁচে থাকে। অমর হয়ে যায়। সাবানা আজমির টুইটÑ মান্না দে এক স্বতন্ত্র কণ্ঠের অধিকারী। নিজের গানের মধ্যে দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন। অনুপম খের বলেছেন, মান্না দে সেই কিংবদন্তি শিল্পীদের মধ্যে প্রথম, যাঁর গান আমি শিমলায় একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম। তিনি তাঁর কণ্ঠস্বরের মতোই ভদ্র ও শান্ত ছিলেন। তাঁকে খুব মিস করব। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তবলার জাদুকর ওস্তাদ জাকির হুসেন বলেছেন, শেষ স্বর্ণকণ্ঠ শিল্পী চলে গেলেন। মধুর ভ-ারকর টুইটে লিখেছেন, মান্না দা, সোনালি কণ্ঠের অধিকারী কিংবদন্তি শিল্পী। দশকের পর দশক ধরে আমাদের হৃদয়ে রাজত্ব করেছেন। সবাই তাঁর শূন্যতা অনুভব করবে। বাপ্পি লাহিড়ী বলেছেন, তিনি সুরসম্রাট ছিলেন। সঙ্গীত গুলে খেয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গীতজগৎ পিতৃস্থানীয়কে হারাল। আরতি মুখোপাধ্যায় বলেছেন, উনি নিজেই সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠান ছিলেন। ওঁর প্রয়াণে অপুরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। অনুপ ঘোষাল বলেন, মান্না দে এক পরিপূর্ণ শিল্পী। প-িত অজয় চক্রবর্তী বলেন, দেশের সাঙ্গীতিক বাবা চলে গেলেন। মান্না দে ভারতের রতœ। হৈমন্তী শুক্লা বলেছেন, তিনি আমার বাবার মতো ছিলেন। আমি আজ যেটুকু জানি সবই তাঁর জন্য। মৃত্যুতে তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলাম। সেইসঙ্গে গানের জগতের বিরাট ক্ষতি হলো। শ্রীকান্ত আচার্য বলেছেন, মান্না দের মতো শিল্পী শতাব্দীতে এক বারই আসেন। অপর্ণা সেন বলেছেন, ওঁর সঙ্গে আমার খুব বেশি দেখা হয়নি, সেই দুঃখ চিরকাল রয়ে যাবে। এই মৃত্যু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এক বিরাট ক্ষতি। শ্রেয়া ঘোষাল বলেছেন, সারা জীবন তিনি সঙ্গীতের সাধনা করে গেছেন। শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, মানুষ হিসাবেও খুব ভাল ছিলেন। তিনি মারা যাননি, তিনি অমর। অভিজিৎ বলেছেন, ‘কফি হাউস’ থেকে ‘আমি যে জলসাঘরে’ এসব গানের মাঝে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি ভগবানের দূত। একইভাবে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা।
রাজনীতিবিদদের শোক ॥ পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী তিওয়ারি টুইটারে লিখেছেন, মান্না দের মৃত্যুতে আমি গভীর শোকাহত। আরও এক কিংবদন্তি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাঁর কণ্ঠ ও গায়কীতে একটা গোটা প্রজন্ম মজে ছিল। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদিও বাদ যাননি। তাঁর টুইট, আমরা এক কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীকে হারালাম। তাঁর অমর কণ্ঠ আমাদের মধ্যে সারাজীবন থাকবে। সুষমা স্বরাজ টুইটারে লিখেছেন, মহানগায়ক মান্না দের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই।