কৃষি অধিদফতরের প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি
ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো পরিচালিত হয় ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। বেশি দুর্নীতি হয়েছে ‘খামার পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ এবং ‘কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীন জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রকল্পে’। এমন অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট কৃষিবিদ নূরস সফিউর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফর (ডিএই)। কিন্তু এক বছরেও ওই কমিটি প্রতিবেদন দেননি। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই দু’টি প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন।
গত ২০ আগস্ট অধিদফতরের মহাপরিচালককে লিখা দুদক সহকারী পরিচালক আবুবকর সিদ্দিক স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, ‘কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্পের শেষ অর্থবছরে (২০১০-১১) ৫৬টি জেলার ১১২টি উপজেলার প্রত্যোটিতে ২০ জন কৃষককে একটি করে হ্যান্ডশাওয়ার দেয়ার শর্ত থাকলেও তা পেয়েছে মাত্র ২০ উপজেলার কৃষক। অবশিষ্ট ৯২টি উপজেলার কৃষকদের কোনো হ্যান্ডশাওয়ার দেয়া হয়নি। এতে ফল ও সবজিগাছে সেচ ও ওষুধ স্প্রের মাধ্যমে পোকা-মাকড় দমন কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হয়েছে কৃষক। অথচ প্রতিটি হ্যান্ডশাওয়ারের মূল্যবাবদ ১২ হাজার টাকা করে আত্মসাৎ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা যোগসাজশ করে চালানে ভুয়া স্বাক্ষর করে হ্যান্ডশাওয়ারের বিল তুলে নেন। এছাড়া ওই প্রকল্পের খাল খননসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম দুর্নীতি করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১০-১১ সালে প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর বেশিরভাগ টাকাই দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া ৫ বছর মেয়াদি ‘খামার পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের আওতায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৫টি জেলার ৯০টি উপজেলায় সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ৯০টি ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা (বারিড পাইপ) নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়। কৌশলে দরপত্র পরিবর্তন করে পছন্দের ৪ ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ৪৫টি মোটর সাইকেল কিনে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ডিজেল প¬্যান্ট লিমিটেড থেকে হিরো হুন্ডা প্রচলিত বাজারদরের বেশি মূল্যে (প্রতিটি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়) কেনেন। অথচ ওই মোটরসাইকেলের ডিলার এটলাস বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্ধারিত মূল্য ১ লাখ ১৪ হাজার।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের এলাকা ভ্রমন না করে ভুয়া বিলের মাধ্যমে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে জ্বালানি খাতে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এমনকি যেসব দিনে হরতাল অবরোধ ছিল, ওইসব দিনেও প্রকল্প পরিদর্শনের নামে জ্বালানি বিল তোলা হয়েছে। এভাবে ভুয়া বিলের মাধ্যমে গত অর্থ বছরে (২০১৩-১৪) জ্বালানি খাতে তোলা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
দুদক সূত্র জানায়, আগের ‘কৃষি প্রকৌশল প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের পুরাতন চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্র নতুন প্রকল্প ‘খামার পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে অফিস সরঞ্জাম ক্রয় দেখিয়ে ৪ লাখ টাকা, ডিজিটাল ফেস্টুন-বুকলেট বাবদ ৪ লাখ টাকা, প্রকল্পের ৪৫টি জেলায় কোন বরাদ্দ না দিয়ে মেরামত খাতে ৫ লাখ টাকা এবং ষ্টেশনারি খাতে ৮ লাখ টাকাসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ৫০ হাজার টাকার ডিজিটাল ফেস্টুন বানিয়ে ১০ লাখ টাকা, মাঠ পর্যায়ে বরাদ্দ না দিয়ে স্টেশনারি খাতে ১১ লাখ টাকা, মেরামত ও সংরক্ষণ খাতে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আসবাবপত্র খাতে ২৮ লাখ টাকা এবং অন্যান্য খাত মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। খামার বাড়িতে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারাই দুদকে এসব কাল্পনিক অভিযোগ দাখিল করেছে।