কুষ্টিয়ায় শিশুসহ প্রকাশ্যে ৩ হত্যার
রবিন। বয়স মাত্র ৫। নিষ্পাপ এক শিশু। মায়ের সাথেই থাকতো। পৃথিবীর ভালো-মন্দ বুঝে ওঠার আগেই গুলির আঘাতে নিভে গেছে তার জীবন প্রদ্বীপ। রবিন মৃত্যুর আগে নিজের চোখে দেখেছে মায়ের নির্মম মৃত্যুও। নিজের জীবন রক্ষায় অজানা পথে দৌড়ে পালানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু নির্দয় ঘাতকের গুলি তাকে বাঁচতে দেয়নি।
রবিনের অপরাধ তার মা পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে ছিলেন। এই অপবাদে পুলিশ স্বামী সৌমেন রায়ের গুলিতে নিহত হয়েছেন স্ত্রী আসমা। একইসাথে শিশু রবিন ও আসমার কথিত প্রেমিক শাকিল। হত্যাকারী পুলিশ কর্মকর্তা সৌমেন রায় আসমার স্বামী হলেও রবিনের জন্মদাতা বাবা নন। রবিন ছিল আসমার দ্বিতীয় স্বামী রুবেলের সন্তান। আর আসমা ছিলেন সৌমেন রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী।
সৌমেনের প্রথম স্ত্রী পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গ্রামের বাড়ি মাগুরায় থাকেন। প্রথম স্ত্রী থাকার পরও সৌমেন রায় পাঁচ বছর আগে আসমাকে বিয়ে করেন। আসমা আর সৌমেন রায় দু’জন ভিন্ন ধর্মের হলেও তাদের বিয়েতে বাধা হয়নি। এই বিয়েতে বাধা হতে পারেনি আসমার সন্তান বা সৌমেন রায়ের ঘরে থাকা প্রথম স্ত্রীও। তাহলে এমন কী হলো যে সৌমেন ট্রিপল মার্ডার করলেন দিন দুপুরে?
হত্যার পেছনে আসমার পরকীয়া!
স্থানীয় সূত্র বলছে, পরকীয়ার জেরেই স্ত্রী, স্ত্রীর সন্তান ও স্ত্রীর প্রেমিককে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছেন পুলিশের এএসআই সৌমেন রায়। লোমহর্ষক এই হত্যাটি কুষ্টিয়া শহরের কাস্টমস মোড়ে রোববার বেলা ১১টার দিকে হয়। স্থানীয়রা ঘাতক ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। ঘাতক প্রথমে স্ত্রী, পরে স্ত্রীর প্রেমিক ও সব শেষে শিশু রবিনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। পরে পাশের বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিলেও জনতার হাত থেকে রক্ষা পাননি ঘাতক। তাকে আটক করে স্থানীয়রা পুলিশে দেয়। দিনে দুপুরে এভাবে হত্যার ঘটনাটি এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। একইসাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
জানা গেছে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম।
এলাকাবাসী জানায়, বেলা ১১টার দিকে শহরের কাস্টমস মোড় মসজিদের পাশে পাঁচ বছরের শিশু সন্তান রবিনকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মা আসমা খাতুন (২৫)। পাশে ছিলেন আসমার কথিত প্রেমিক বিকাশে কর্মরত শাকিল (৩০) ও আর আসমার তৃতীয় স্বামী পুলিশের এএসআই সৌমেন রায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সৌমেনের হাতে থাকা সরকারি পিস্তল আসমার মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করলে আসমা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপরই আসমার প্রেমিক শাকিলের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আরেকটি গুলি করলে তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুলির শব্দ ও মায়ের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে শিশু সন্তান রবিন। এ সময় অবুঝ শিশু রবিনকে লক্ষ করে তিন থেকে চারটি গুলি করলে সেও ঘটনাস্থলেই নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
পরপর গুলির শব্দ শুনে আশপাশের পথচারী ও লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে এলে ঘাতক সৌমেন রায় পাশের বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নেন। অন্য দিকে স্থানীয়রা দ্রুত গুলিবিদ্ধ তিনজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক প্রথমে আসমাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর শাকিল ও শিশু রবিনকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠায় হয়। কিন্তু কিছু সময় পর তাদের দু’জনকেও মৃত ঘোষণা করা হয়।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে ওই বাড়ি থেকে ঘাতক পুলিশের এএসআই সৌমেন রায়কে পিস্তলসহ আটক করে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম। পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির উপযুক্ত বিচার হবে।
এ দিকে খুলনার পুলিশ সুপার জানান, এএসআই সৌমেন রায় ফুলতালা থানায় কর্মরত ছিলেন। কিন্তু শনিবার থেকে তিনি আন অফিসিয়ালি থানার বাইরে রয়েছেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নিহত শাকিল (২৮) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাওতা কারিগর পাড়ার মিজবারের ছেলে। একই উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নে নাতুড়িয়া গ্রামের মেয়ে আসমা (২৫) ও ছেলে রবিন (৫)। রবিন আসমার দ্বিতীয় স্বামী রুবেলের সন্তান।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, নিহত আসমা এএসআই সৌমেনের দ্বিতীয় স্ত্রী। আর সৌমেন রায় হচ্ছেন আসমার তৃতীয় স্বামী। পাঁচ বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। আসমা শিশু সন্তান রবিনকে নিয়ে সৌমেনের সাথে বসবাস করতেন। দু’বছর আগে সৌমেন রায় কুষ্টিয়া থেকে বদলি হয়ে খুলনায় যান। এরই মধ্যে আসমার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে শাকিলের। বিষয়টি জেনে বেশ কয়েকবার শাকিল থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। রোববার সকালে আসমাকে সন্তানসহ সৌমেনের বর্তমান পোস্টিং খুলনার ফুলতারা থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সকালে আসমার মায়ের বাবর আলী গেটের বাসা থেকে বের হয়। এ সময় আসমা সৌমেনের সাথে খুলনায় যাবে না বলে জানান। এ নিয়ে আসমা ও সৌমেন রায়ের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সৌমেন বলেন, শাকিল বললে তুমি যাবা কি না? তখন মোবাইল ফোনে কল দিয়ে শাকিলকে সৌমেন বলেন, কোথায় আছ? শাকিল বলেন আমি কাস্টমস মোড়ে আছি। সেখানে সৌমেন আসমাকে সাথে নিয়ে হাজির হন। একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে সৌমেন নিজের মাজায় থাকা সরকারি পিস্তল বের করে একসাথে তিনটি হত্যা করেন।
আসমার মা ও ভাইয়ে আহাজারি
মেয়ে ও নাতি হত্যার খবর পেয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ছুটে আসেন আসমার মা ও ভাই। তাদের আহাজারি আর বিলাপে হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে।
এ দিকে হাসপাতালে তিনটি লাশ দেখতে হাজারো মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। নিহত আসমার মা জানান, সৌমেনের সাথে আসমার সম্পর্ক ভালো ছিল না। সৌমেন আসমাকে নির্যাতন করত। যে কারণে আসমা আমার কাছে থাকত। সকালে খুলনায় যাওয়ার জন্য সৌমেনের সাথে আসমা ছেলেসহ বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু কী কারণে আমার মেয়ে ও নাতিকে গুলি করে হত্যা কররো তা বলতে পারবো না।
তিনি আরো বলেন, শাকিল নামের কাউকে আমি চিনি না। তবে আসমা মোবাইলে প্রায় সময় একজনের সাথে কথা বলত।
আসমার ভাই হাসান জানান, আমার বোনের আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিল। রবিন দ্বিতীয় স্বামী রুবেলের সন্তান। পাঁচ বছর আগে সৌমেনের সাথে আসমার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আসমার ওপর নির্যাতন করতেন সৌমেন।
এএসআই সৌমেন রায়ের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার কসবা গ্রামে। সেখানে তার প্রথম স্ত্রী ও পরিবার রয়েছে।
এ দিকে আসমার প্রেমিক শাকিলের সাওতা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জানা গেছে, তারা আসমা নামের কাউকে চেনেন না। এলাকাবাসী জানায়, শাকিল ভালো ছেলে হিসেবে সকলে চিনে। বিকাশের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ময়নাতদন্ত শেষে আসমা ও রবিনের লাশ আসমার মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অপর দিকে শাকিলের লাশ তার পরিবারের লোকজন গ্রহণ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। আপনজন হাড়ানো বেদনায় উভয় গ্রামের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আটক এএসআই সৌমেনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।