কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন পারল না বরিশাল
ড্যারেন স্টিভেন্স ও অলক কাপালী একের পর এক বল ব্যাটে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন, আর ড্রেসিংরুমে শুকনো মুখে পায়চারী করছেন অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা। এত কাছে এসেও ট্রফিটা কি তবে হাতছাড়া হয়ে যাবে কুমিল্লার? টেনশন! শুধু মাশরাফি নন, গ্যালারিতে কুমিল্লার সব সমর্থকও তখন স্নায়ুচাপে স্তব্ধ। শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ২৩ রান। ১৯তম ওভারে কেভন কুপারের প্রথম দু’বলেই আউট স্টিভেন্স ও মাশরাফি। এবার সমীকরণ আরও কঠিন। নয় বলে প্রয়োজন ২৩। কাপালীর ওপর সমর্থকদের আক্রোশ আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিপিএলের নিলামে প্রথমে দল না পাওয়া কাপালীকে পরে দলে টেনে কি তবে ভুল করল কুমিল্লা! না। ওই ওভারের তিন বলে ১০ রান নিয়ে ম্যাচ জমিয়ে দিলেন কাপালী। শেষ ওভারে দেখালেন আসল জাদু। শেষ ওভারে ১৩ থেকে লক্ষ্যটা শেষ বলে এক রানে গিয়ে ঠেকল। শর্ট ফাইন লেগে বল ঠেলে দিয়েই একটি রান নিয়ে নিলেন কাপালী। টুর্নামেন্টে শুরুর আগে যাকে সবাই বাতিলের খাতায় রেখেছিলেন, সেই কাপালীই কাল ফাইনালে ২৮ বলে অপরাজিত ৩৯ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলে জেতালেন কুমিল্লাকে। শেষ বল পর্যন্ত রোমাঞ্চ ছড়ানো ফাইনালে বরিশাল বুলসকে তিন উইকেটে হারিয়ে বিপিএলের তৃতীয় আসরের শিরোপা জিতে নিল মাশরাফি মুর্তজার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।। শেষ বলে রোমাঞ্চকর জয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাড লাইটের আলো বন্ধ করে দেয়া হয়, গ্যালারিতে দর্শকদের মোবাইলের আলোগুলো তখন জ্বলে উঠল টিম টিম করে। এই আলোতেই সতীর্থদের বাঁধনহারা উদ্যাপনে হারিয়ে গেলেন বাতিলের খাতা থেকে হিরো বনে যাওয়া কাপালী। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে বরিশাল বুলসের বিপক্ষে ১৫৭ রান তাড়া করতে নেমে সাত উইকেট হারিয়ে শেষ বলে রোমাঞ্চকর জয় তুলে নেয় মাশরাফির দল। ইমরুল কায়েসের হাফ সেঞ্চুরি (৫৩) ও কাপালীর ৩৯* রানে বিপিএলে নিজের অভিষেক আসরেই শিরোপা উঁচিয়ে ধরল কুমিল্লা।
মাশরাফি বিপিএলে নিজের হ্যাটট্রিক ট্রফিটা উঁচু করতেই আতশবাজির রোশনাইয়ে আলোকিত হয়ে ওঠে মিরপুরের রাতের আকাশ। টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল এই বাজির ফোয়ারায়, শেষটাও হল একইভাবে।
টুর্নামেন্টের নিজেদের প্রথম দুটি ম্যাচ ছাড়া ইমরুল কুমিল্লার আশার ফুল হয়েই ফুটেছেন। শেষ চার ও ফাইনালে আরও উজ্জ্বল তিনি। ইমরুলের টি ২০ রূপটা আরও ভয়ংকর। ৩৯ রানের সময় হঠাৎ বাঁ-পায়ে টান পেলেন তিনি। এক পায়ের জোরেই ইমরুল প্রসন্নকে লং-অনে টানা দু’বলে ছক্কা মেরে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন। এরপর অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ৫৩ রানে মাহমুদউল্লাহর বলে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। কুমিল্লার চাপে পড়া শুরু সেখান থেকেই। তবে শেষ পর্যন্ত সব সমীকরণ মিলিয়ে রূপকথার মতোই সমাপ্তি টানলেন কাপালী। অনুমিতভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে তার হাতে। টুর্নামেন্ট-সেরা হয়েছেন কুমিল্লার পাকিস্তানি অলরাউন্ডার আজহার জায়দি। কাল মিরপুর স্টেডিয়ামে আসনের দ্বিগুণ দর্শক হয়ে যায়! গেটম্যান ও পুলিশকে কিছু ধরিয়ে দিয়ে মাঠে প্রবেশ করেছেন অনেকে। ফাইনালে দর্শকদের এই উপচে পড়া ভিড় বিপিএলকে রাঙিয়েই দিল।
এর আগে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে চার উইকেটে ১৫৬ রান তোলে বরিশাল বুলস। ফাইনালে দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দিতে সবচেয়ে বড় অবদান অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ও শাহরিয়ার নাফীসের। চতুর্থ উইকেটে ৫৮ বলে ৮১ রানের জুটি গড়ার পথে শেষদিকে দু’জনই ঝড় তুলেছিলেন। শেষ ওভারে কুমিল্লার লংকান পেসার নুয়ান কুলাসেকারার বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৩৬ বলে ছয় চার ও এক ছক্কায় ৪৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন মাহমুদউল্লাহ। আর ৪৪ রানে অপরাজিত থাকেন শাহরিয়ার নাফীস। তার ৩১ বলের ঝড়ো ইনিংসটি দুটি চার ও তিনটি ছক্কায় সাজানো। বরিশালের শুরুটাও মন্দ ছিল না। তৃতীয় ওভারে মেহেদি মারুফের (১১) বিদায়ে ভাঙে ১৯ রানের উদ্বোধনী জুটি। এরপর দলকে এগিয়ে নেন আরেক ওপেনার সিকুগে প্রসন্ন। মাত্র ১৯ বলে দুটি করে চার-ছক্কায় সাজানো তার ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস শেষ হয় ড্যারেন স্টিভেন্সের বলে বোল্ড হয়ে। বরিশালের আগের দু’ম্যাচের হিরো সাব্বির রহমান অবশ্য জ্বলে উঠতে পারেননি ফাইনালে। ১৯ বলে মাত্র ৯ রান করে কুমিল্লা অধিনায়ক মাশরাফির বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন সাব্বির। ৬৮ রানে তিন উইকেট হারানোর পর বরিশালের ইনিংস দেড়শ’ ছাড়ায় মাহমুদউল্লাহ ও শাহরিয়ার নাফীসের দৃঢ়তায়। কুমিল্লার পক্ষে একটি করে উইকেট নেন আজহার জায়দি, কুলাসেকারা, স্টিভেন্স ও মাশরাফি।
এর আগে ২০ নভেম্বর বলিউড সুপারস্টার ঋত্বিক রোশন, জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ ও কণ্ঠশিল্পী কেকের মতো তারকাদের স্টেজ পারফরম্যান্স দিয়ে পর্দা উঠেছিল বিপিএলের তৃতীয় আসরের। এর এক দিন পর ২২ নভেম্বর শুরু হয় মাঠের লড়াই। চিটাগাং ভাইকিংসের বিপক্ষে রংপুর রাইডার্সের শেষ বলের জয়ে রোমাঞ্চের বার্তা দিয়ে শুরু হয় বিপিএল। প্রথম কয়েকটি মাচের নিষ্পত্তি হয়েছে শেষ ওভারে। তবে শুরুর এই আকর্ষণটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। একের পর এক লো স্কোরিং ও একপেশে ম্যাচ হতে থাকে।
বরাবরের মতো ভারতের ক্রিকেটাররা এবারও বিপিএলে খেলতে আসেনি। ব্যস্ততার কারণে পাওয়া যায়নি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদেরও। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররাই বিপিএলের বড় ভরসা ছিল। বিদেশীদের মধ্যে বড় আকর্ষণ ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল, পাকিস্তনের শহীদ আফ্রিদি ও শ্রীলংকার কুমার সাঙ্গাকারা। টুর্নামেন্টে মাঝপথে যোগ দেয়া আফ্রিদির সিলেট শেষ চারেই উঠতে পারেনি। বরিশালের গেইল ফাইনালের আগেই বিগ ব্যাশে খেলতে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ায় বিপিএল অনেকটাই রং হারায়। ফাইনালে শোয়েব মালিক, নুয়ান কুলাসেকারা, কেভন কুপাররা থাকলেও আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন সেই মাশরাফি-মাহমুদউল্লাহরাই। টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন কুমিল্লার তরুণ পেসার আবু হায়দার রনি। টুর্নামেন্টের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান বরিশালের এভিন লুইস। একমাত্র হ্যাটট্রিকও করেছেন বরিশালের পেসার আল-আমিন হোসেন। এছাড়া ব্যাটিংয়ে তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েসরা দেশী ক্রিকেটারদের মধ্যে ভালো করেছেন। বিদেশীদের মধ্যে চমক দেখিয়েছেন পাকিস্তানের আজহার জায়দি। ক্যারিবীয় ব্যাটিং দানব গেইলের ঝড় দেখা গেছে একটি ম্যাচে।
টুর্নামেন্টের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সিলেটের প্রথম ম্যাচে বিদেশী খেলোয়াড়ের কোটা পূরণ না হওয়ায় নিয়ম পরিবর্তন করে দুই বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে ম্যাচ খেলানো। একই ম্যাচে সিলেটের মালিক আজিজুল ইসলাম বাবা-মা তুলে গালি দিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন চিটাগাং ভাইকিংস অধিনায়ক তামিম। চট্টগ্রাম পর্বে চিটাগাং ভাইকিংস ও বরিশাল বুলসের ম্যাচে ফিক্সিংয়ের অভিযোগও উঠেছে। পরের ম্যাচেই ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে উমর আকমলকে নিয়ে গিয়ে মাঠে নামায় চিটাগাং। ভালো দল হওয়া সত্ত্বেও সিলেট জয়ের স্বাদ ভুলতে বসায় মুশফিকুর রহিমের পরিবর্তে অধিনায়ক করা হয় আফ্রিদিকে। তাতেও অবশ্য সিলেটের ভাগ্য পরিবর্তন না হওয়ায় গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। তারকাখচিত দলগুলোকে বিদায় করে দিয়ে ফাইনালে উঠে যায় মাশরাফি মুর্তজার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। আর সাকিব আল হাসানের রংপুর রাইডার্সকে হারিয়ে সাব্বির রহমান ফাইনালে তুলে দেন বরিশালকে।