কুমিল্লায় সাক্কু জয়ী

31/03/2017 11:43 amViews: 24

কুমিল্লায় সাক্কু জয়ী

 

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৬৮,৯৪৮ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৭৫৬৩ ভোট। ১১,৩৮৫ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো কুসিকের নগরপিতা নির্বাচিত হলেন মনিরুল হক সাক্কু। এর আগে সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হয়ে চলে বেলা ৪টা পর্যন্ত। কেন্দ্র দখল, প্রিজাইডিং কর্মকর্তার উপর হামলা, কাউন্সিলর প্রার্থী ও এজেন্টকে মারধর, ককটেল বিস্ফোরণ, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ দিনভর উত্তেজনার মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে কুসিক নির্বাচন। এসব ঘটনায় স্থগিত করা হয় দুই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ। কেন্দ্র দুইটি হচ্ছে- কুমিল্লা সরকারী সিটি কলেজ এবং চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাযিল মাদ্রাসা। কুসিকের ভোটগ্রহণ নিয়ে নানা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ ছিল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ। প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই ছিল ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন সতর্ক। কিছু কিছু কেন্দ্র সরকার দলীয় কর্মীরা দখলের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ভোট দিতে এসে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সীমা বলেছেন, ফলাফল যাই হোক তা তিনি মেনে নেবেন। অন্যদিকে মনিরুল হক সাক্কুও ফলাফল মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েকটি কেন্দ্রে তার এজেন্টকে বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ আনেন। তিনি সরকার দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল ও জালভোটের অভিযোগ করেন।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশ কটি কেন্দ্রের বাইরে ছিল সরকার দলীয় লোকজনের মহড়া। কোনো কোনো কেন্দ্রে আবার বুথের ভেতরই অবস্থান নিয়েছিলেন নৌকা সমর্থকরা। তারা ভোটারদের তাদের সামনেই নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দিয়েছেন। বিপরীতে অনেকটাই মাঠ ছাড়া ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। নতুন নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আস্থায় আনতে না পারলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে কুসিক নির্বাচনকে ইসির অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল বিএনপি। নির্বাচনী প্রচারণায়ও মুখর ছিল দলটির নেতাকর্মীরা।
সময় তখন বেলা ১০টা। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের থিরাপুকুর পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মহিলা কেন্দ্রের গেটের বাইরে তখন দীর্ঘ লাইন। কিন্তু লাইন সামনের দিকে এগোচ্ছে না। লাইনে দাঁড়ানো মহিলারা বিরক্তি প্রকাশ করছেন। কেন্দ্রে ঢুকে দেখা গেল অন্যরকম চিত্র। নির্বাচন কর্মকর্তা বা প্রার্থীর কোনো ব্যাজ ছাড়াই কয়েকজন যুবক অবস্থান করছেন দোতলার একটি বুথে। তারা যে বুথে ঢুকছেন সেই বুথের সিরিয়াল নম্বর ডাকা হচ্ছে বাইরে। তারা তাদের উপস্থিতিতেই ভোটারদের নৌকা ও সরকার সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন। নারী কেন্দ্রে পুরুষ হিসেবে তাদের উপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আমরা সহযোগিতা করতে এসেছি। কাছেই বড়পুকুর পাড় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় একজন মহিলা জোরে জোরে চিৎকার করছেন। আর তাকে ঠেলে গেটের দিকে বের করে আনছেন একজন পুলিশ সদস্য। মহিলার নাম নূরজাহান বেগম, ভোটার নম্বর-৩৭৩। চর্থা দক্ষিণ বাসিন্দা এ নারী কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে প্রিজাইডিং অফিসার মোশাররফ হোসেন বলেন, এটি কোনোভাবে ভুল হয়ে গেছে।
বেলা সাড়ে ১০টা। ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজ কেন্দ্র। কলেজের পাশাপাশি দুই ভবনে নারী-পুরুষ দুই কেন্দ্র। শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। এই সময় কেন্দ্রে যান ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী কাজী মাহবুবুর রহমান। তিনি কেন্দ্রের বাইরে মাঠে গেলে হঠাৎ করেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে নৌকার ব্যাজ পরা বেশ কয়েজন লোক। কাজী মাহবুবকে সমানে মারধর শুরু করলে পুলিশ তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। এ সময় বাইরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রের বাইরে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। বাইরে যখন উত্তেজনা ঠিক তখনই নৌকার ব্যাজপরা বেশ কয়েকজন ঢুকে পড়ে পুরুষ কেন্দ্রের কয়েকটি বুথে। তারা জোর করে সাক্কু ও কাজী মাহবুবের এজেন্ট জামাল হোসেনসহ কয়েকজনকে বের করে দিয়ে নৌকা ও মিষ্টি কুমড়া প্রতীকে সিল মারতে শুরু করে। তাদেরই একজন ১ বুথে গিয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের ২ নম্বর বুথ থেকে দুইটি ব্যালেটের বাণ্ডিল ছিনিয়ে নেয়। অন্যদিকে ৪ নম্বর বুথ গিয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার বিজয় চক্রবর্তীর হাত থেকে সিল ছিনিয়ে নেয় আরেকজন। সবার সামনেই তারা সিল মেরে বাক্সে ভরতে শুরু করে। এ সময় বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল নিরব। এমন পরিস্থিতিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দেয়া হয়। প্রিজাইডিং অফিসার ফরিদ আহমেদ জানান, ১০টা ৫০ মিনিটে কিছু লোক অতর্কিতভাবে কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। বিভিন্ন বুথে ঢুকে তারা সিল মারতে থাকে। খবর পেয়ে কেন্দ্রে ছুটে যান বিএনপির মেয়র প্রার্থী সাক্কু। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারাই দেখছেন কি রকম ভোট হচ্ছে। এটাই যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তবে জনগণ তা দেখবে। রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডল সাড়ে এগারোটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। তিনি প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে পুরো ঘটনাটি শোনেন। প্রিজাইডিং অফিসার যখন বুথে বুথে ঢুকে সিল মারার অভিযোগ করছিলেন তখনই কথা বলে ওঠেন ১ নম্বর বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার। রিটার্নিং অফিসারের উদ্দেশে তিনি জোরে জোরে বলতে থাকেন- ‘স্যার আমার দুই বান্ডিল।’ এ সময় প্রিজাইডিং অফিসার হিসাব দেন সব বুথ মিলিয়ে জোর করে প্রায় ৪৫০টি জাল ভোট দেয়া হয়েছে। সব শুনে রকিব উদ্দিন মণ্ডল প্রিজাইডিং অফিসারকে পুরো ঘটনাটি লিখিত দিতে বলেন। পরে কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। রিটার্নিং অফিসার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বে অবহেলা করলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুপুর তখন সাড়ে ১১টা। ৪৯ নম্বর হোচ্ছামিয়া স্কুল কেন্দ্রের গেটে হঠাৎ করেই শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ২৫-৩০ জন বিএনপি সমর্থক একসঙ্গে দল বেঁধে ভোট দিতে এসেছেন। কিন্তু গেটে তাদের আটকে দিয়েছে সরকার দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী কাইয়ুম খান বাবুলের লোকজন। এ নিয়ে হাতাহাতি। ধাক্কাধাক্কি করে ১৫ জনের মতো কেন্দ্রে ঢুকতে পারলেও বাকিদের তখন হুমকি-ধমকি দিয়ে গেটে আটকে রাখে। কেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও তারা ছিলেন নির্বিকার। দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা লোকাল নেতাকর্মীদের নিজেদের বিষয়। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ল কলেজ কেন্দ্রের উঠোনে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার ছোট ভাই ইমরান। তার কারণে ওই ওয়ার্ডের বিএনপি নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের আশপাশেই যাননি। বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু নিজে কয়েকবার ওই দুই কেন্দ্রে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। দুপুর আড়াইটার সময় তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, এভাবে মহড়া দিয়ে ভোটারদের আটকে দিলেও সরকার দলীয় লোকজন নিজেদের কর্মীদের দিয়ে জাল ভোট দিলে নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু হবে।
দুপুর সাড়ে ১২টা। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌয়ারা ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে বসেই নৌকা প্রতীকে সিল মারছিলেন কয়েক যুবক। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান ধানের শীষ প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। তিনি রিটার্নিং অফিসারকে অভিযোগ করলে ঘটনার সত্যতা পেয়ে কেন্দ্রটির ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট চৌয়ারা থেকে চলে যাবার পর একই ওয়ার্ডের পাশের কেন্দ্র চৌয়ারা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যান কয়েকজন যুবক। তারা জোর করে ভোট দিতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশের ওসি তা প্রতিরোধ করে। এ ব্যাপারে দাউদকান্দি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, চৌয়ারার দুটি কেন্দ্রে দুর্বৃত্তরা ভোট কাটতে চাইলেও আমরা বাধা দিয়েছি।
ধানের শীষের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে থেকে তার এজেন্টদের জোর করে বের করে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পুরো কেন্দ্রে বা কেন্দ্রের কোনো কোনো বুথে ধানের শীষের এজেন্ট নেই। সরকারদলীয় লোকজন হুমকি-ধমকি দিয়ে বেশ কিছু কেন্দ্র থেকে তাদের বের করে দিয়েছে।
দুপুর দুইটা। নানুয়া দীঘির পাড়ে শৈলরানী স্কুলে দুইটি মহিলা কেন্দ্র। বাইরে বা ভেতরে নেই একজন ভোটারও। অলস সময় কাটাচ্ছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোশাররফ হোসেন বলেন, ১টার মধ্যে ৬০ভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে। এরপর ভোটারদের উপস্থিতি একেবারেই কম। দুপুর সোয়া দু’টার সময় একই দৃশ্য দেখা গেছে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অহিদ উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৫৬ নম্বর দি ক্যামব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে। তবে সকাল থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে লাইনে দাঁড়ায়। এ সময় লম্বা লাইন দেখা যায়। তবে ভোটারদের মধ্যে মহিলা ভোটারের সংখ্যা ছিল বেশি। কয়েকজন ভোটার জানান, সকাল থেকে নিয়ম মতোই ভোটগ্রহণ চলছিল। হঠাৎ বেলা ১০টার পর কিছু কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি করে সরকারদলীয় লোকজন।

Leave a Reply