কারো সমর্থন পেলো না আওয়ামী লীগ
কারো সমর্থন পেলো না আওয়ামী লীগ
তিন সিটিতে সদ্য সমাপ্ত কারচুপির নির্বাচনের পর ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ওই নির্বাচনের পক্ষে দেশি-বিদেশি কিছু সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছিলো সরকার। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন বিভিন্ন মহলের সমর্থন আদায়ে জোর প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছিলো। যদিও বাস্তবে ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচনই হয়নি বলে প্রায় সব মহলই মত দিয়েছিলেন। কেননা ভোটের আগেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে রাখা হয়েছিলো।
৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো শতকরা ৫ ভাগ মানুষও ভোট কেন্দ্রে যায়নি। ওই নির্বাচনে ৪০টিরও বেশি ভোট কেন্দ্রে একজন ভোটারও উপস্থিত হয়নি। যদিও ৫ জানুয়ারির পর নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কখনো শতকরা ৩৭ ভাগ আবার কখনো ৪০ ভাগেরও বেশি ভোট পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। নির্বাচনের পরের দিন ৬ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর সংগঠন ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ ৩০ দশমিক শুন্য ১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে দাবি করা হয়নি। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি (নির্বাচনের ২ দিন পর) আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সভায় বলেছিলেন, নির্বাচন সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য সে কথাও বলা যাবে না। তারপরও সরকারের অনুগত হিসেবে পরিচিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলো। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যেকোনো উপায়ে একটি নির্বাচন দরকার বলেও অনেকে যুক্তি দিয়েছিলেন।
কিন্তু ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভোটের দিন (২৮ এপ্রিল) দুপুর সোয়া ১২টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এসময় ঢাকা উত্তর সিটিতে বিএনপি সমর্থিত তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজাও উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে মওদুদ আহমেদ ৫ শতাংশ মানুষও ভোট কেন্দ্রে যায়নি বলে দাবি করেন।
তাছাড়া সিটি নির্বাচনের পর কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করেনি। দেশের প্রভাবশালী বেসরকারী টেলিভিশন, দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর প্রধান প্রধান শিরোনামেও ভোট ডাকাতি, কারচুপি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও সিটি নির্বাচনে সিল মারার সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। অবাক ব্যাপার হলো, সরকারের সঙ্গে জোটে থাকা বাম রাজনৈতিক দলগুলোও সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করেনি। বরং তারা ভেতরে ভেতরে এই কারচুপি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও এ সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপির কঠোর সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন। একইসঙ্গে তিনি সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের মন্ত্রীসভা থেকে বের হয়ে আসার জন্যও বলেছেন।
সিটি নির্বাচনের পর ২ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ১৪ দলের অনেক শরীকই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ঘটনায় সরকার ও আওয়ামী লীগের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে বামপন্থি নেতারা নির্লজ্জভাবে ভোট কারচুপির জোরালো সমালোচনা করেছেন। দুপুর হওয়ার আগেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়া পরও তাদের সমর্থিত প্রার্থীরা এতো ভোট কীভাবে পেলেন সে প্রশ্নও উঠেছে। ভোটের অংকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দুর্বলতার প্রকাশ বলেও কেউ কেউ ওই বৈঠকে মন্তব্য করেন।
ওই বৈঠকে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, দুপুরের আগেই ভোট বর্জনের পরেও এত ভোট বিএনপি কীভাবে পায়? তিনি বলেন, এখনও সময় আছে। আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের একজন নেতা বলেছেন, ভোটের দিন যা করা হয়েছে তা খুবই অনাকাঙ্খিত। এটা না করলেও জয় আসতে পারতো। এতে করে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ভাবমর্যাদাও ক্ষুন্ন হয়েছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা সিটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে অভিযোগগুলোর তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া ১৪ দলে থাকা অন্য শরীকরাও ভোটের অনিয়মে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে সিটি নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পরই ভোটে অনিয়মের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে বলেছেন। গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে মহাসচিব কী বলেছেন সে সম্পর্কে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সোমবার ওয়াশিংটনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিয়মিত মধ্যাহ্ন ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক।
সদ্য সমাপ্ত তিন সিটিতে যে প্রহসনের নির্বাচন হয়ে গেলো তা নিয়ে সরকারের ভেতরে অসন্তুষ্টি রয়েছে। সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভেতরে ভেতরে সরকারের নৈতিক অবস্থানও দুর্বল হয়ে আসছে। কারণ, একটি নির্বাচন শেষ হওয়ার পর রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ও দেশি-বিদেশি কোনো সংস্থা বা সংগঠনের কাছ থেকে এর পক্ষে সমর্থন আদায় করা যায়নি।
– See more at: http://www.sheershanewsbd.com/2015/05/06/79641#sthash.T23NmWFv.dpuf